মঙ্গলবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১ আশ্বিন ১৪৩২
ছবি : সংগৃহীত
রাজবাড়ীর গোয়ালন্দের আলোচিত নুরুল হক ওরফে নুরাল পাগলার (৮৫) দরবারে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, লাশ পোড়ানো, হত্যা এবং পুলিশের ওপর হামলা ও গাড়ি ভাঙচুর ঘটনায় পৃথক দুটি মামলায় এখন পর্যন্ত মোট ২৪ জন আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এর মধ্যে ৮ জন আসামি আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে দুই জন মসজিদের ইমাম ও দুইজন স্থানীয় ছাত্রলীগ-স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা রয়েছেন।
সোমবার (১৫ সেপ্টেম্বর) রাতে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস্) মো. শরীফ আল রাজীব।
এর আগে নুরাল পাগলার দরবারে হামলায় নিহত ভক্ত রাসেল মোল্লার বাবা আজাদ মোল্লা বাদী হয়ে হত্যাসহ অগ্নিসংযোগ, লাশ পোড়ানো, ক্ষতিসাধন, চুরি, জখমের অভিযোগ এনে ৮ সেপ্টেম্বর গোয়ালন্দঘাট থানায় মামলা করেন। এতে অজ্ঞাত পরিচয়ে সাড়ে তিন হাজার থেকে চার হাজার ব্যক্তিকে আসামি করা হয়। এছাড়াও ঘটনার দিন ৫ সেপ্টেম্বর গোয়ালন্দ ঘাট থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) সেলিম মোল্লা বাদী হয়ে পুলিশের ওপর হামলা, সরকারি কাজে বাধা ও সরকারি সম্পত্তি ধ্বংসের অভিযোগ এনে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করেন। আসামি সব অজ্ঞাতনামা হলেও এ দুই মামলায় এখন পর্যন্ত ২৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
পুলিশের ওপর হামলা ও গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনায় গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- গোয়ালন্দ উপজেলার দেওয়ানপাড়া গ্রামের আফজাল সরদারের ছেলে মো. শাফিন সরদার (১৮), উপজেলার উজানচর ইউনিয়নের ১নং দিরাস্তুল্লাহ মৃধাপাড়ার মৃত আক্কাস মৃধার ছেলে ও উজানচর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সহসভাপতি মো. মাসুদ মৃধা (২৯), উপজেলার বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের লাল মিয়া মৃধার ছেলে উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক হিরু মৃধা (৪০), দেওয়ানপাড়া গ্রামের মো. জহির উদ্দিনের ছেলে এনামুল হক জনি (৩২), গোয়ালন্দ পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাজীপাড়া গ্রামের কাজি আরিফের ছেলে কাজী অপু (২৫), গোয়ালন্দ উপজেলার দিরাজতূল্লাহ মৃধা ডাঙ্গী গ্রামের মৃত মকলেছুর রহমান মৃধার ছেলে মো. হায়াত আলী মৃধা (২৯), গোয়ালন্দ উপজেলার ১নং বেপারীপাড়া গ্রামের মো. আইয়ুব আলী গাজীর ছেলে মো. আলমগীর গাজী (৪৫), নজর উদ্দিন সরদার পাড়া এলাকার ইসাহাক সরদারের ছেলে মো. সোহান সরদার (৩৩), ২নং ওয়ার্ড দেওয়ানপাড়া এলাকার নেকবার আলী শেখের ছেলে রিয়াজ হোসেন রিতান্ত (২১), গোয়ালন্দের নতুনপাড়া (মাল্লাপট্টি) এলাকার মো. শওকত সরদারের ছেলে মো. জীবন সরদার (২২), পৌরসভার ৪নং ওয়ার্ড জুড়ান মোল্লাপাড়া গ্রামের আব্দুল মালেক ফকিরের ছেলে সাগর ফকির (২১), মাল্লাপট্টী শাকের ফকিরপাড়া এলাকার হেলাল উদ্দিনের ছেলে মো. সাইফুল ইসলাম শুভ (১৭), ফরিদপুর জেলার কোতোয়ালি থানার ডিগ্রীরচর বারখাদা গ্রামের মো. নিজাম উদ্দিন সরদারের ছেলে মোহাম্মদ ফেরদৌস সরদার (৩৬), গোয়ালন্দ পৌরসভার ৭নং ওয়ার্ডের আদর্শ গ্রামের ছালামের ছেলে মো. বিপ্লব ওরফে বিল্লু (২৮), ফরিদপুর জেলার কোতোয়ালি থানার ঈশান গোপালপুর ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের হাজী গনি শিকদার পাড়া এলাকার মো. মজিবর শেখের ছেলে আসলাম শেখ (২৮) ও গোয়ালন্দ পৌরসভার ৭নং ওয়ার্ডের কাজীপাড়া এলাকার মৃত জয়নাল শেখের ছেলে শহিদুল ইসলাম ওরফে বুদ্দু (৪৫)।
এছাড়াও নিহত রাসেলের বাবার দায়েরকৃত মামলায় গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- গোয়ালন্দ পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের আলম চৌধুরীপাড়ার অভি মণ্ডল ওরফে রঞ্জু (২৯), মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার বড় ঠাকুরকান্দি গ্রামের মাওলানা বাহাউদ্দীনের ছেলে ও গোয়ালন্দ পৌরসভার বাইতুল মোকাদ্দাস জামে মসজিদের ইমাম মুফতি আবদুল লতিফ (৩৫), গোয়ালন্দ পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাজীপাড়ার কাজী আরিফের ছেলে শান্ত কাজী (১৯) এবং ফরিদপুরের সালথা থানার ঘটরকান্দা গ্রামের মৃত আবুল হোসেনের ছেলে মোহাম্মদ আনিসুর রহমান (৩০), শরীয়তপুরের পালং মডেল থানার রশিদ ব্যাপারীর ছেলে লিটন ব্যাপারী (৩৮), গোয়ালন্দ উপজেলার অম্বলপুর গ্রামের মো. আব্দুল জলিল শেখের ছেলে ও গোয়ালন্দ বাজার বড় মসজিদের ইমাম মাওলানা মো. আবু সাঈদ (৪৫), দেওয়ানপাড়া গ্রামের মো. কুদ্দুস শেখের ছেলে মো. রাসেল শেখ (২৪) ও গোয়ালন্দের উজানচর ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ডের নাসের মাতুব্বরপাড়া গ্রামের আকবর শেখের ছেলে নজরুল ইসলাম নজির (৩৩)।
এর মধ্যে মুফতি আব্দুল লতিফ নুরাল পাগলার মরদেহ উত্তোলনের নির্দেশদাতাদের মধ্যে একজন এবং নজরুল ইসলাম নজির নুরাল পাগলার মরদেহ পোড়ানোর সময় পেট্রোল ছিটিয়ে সহায়তা করেছেন।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস্) মো. শরীফ আল রাজীব বলেন, নুরাল পাগলার দরবারে বিক্ষুব্ধ জনতার হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, হত্যা, লাশ পোড়ানোর ঘটনায় ৮ জন ও পুলিশের ওপর হামলা ও গাড়ি ভাঙচুরের মামলায় ১৬ জনসহ মোট ২৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে ৮ জন আদালতে দোষ স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। বাকি আসামিদের গ্রেপ্তারের আমাদের অভিযান চলমান রয়েছে।
রাজবাড়ীর পুলিশ সুপার মো. কামরুল ইসলাম বলেন, পুলিশের ওপর হামলা ও লাশ উত্তোলনের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। সুনির্দিষ্ট তথ্য, ভিডিও ফুটেজ ও প্রাথমিক প্রমাণের ভিত্তিতে অপরাধের সাথে অভিযুক্তদের আইনের আওতায় আনা হবে। মামলায় নিয়ে তদন্ত কাজে কেউ প্রভাব বিস্তার, অনৈতিক তদবির করলে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে বলে জানান জেলা পুলিশের এই কর্মকর্তা।
জেলা প্রশাসক সুলতানা আক্তার বলেন, গোয়ালন্দে নুরাল পাগলের দরবারে হামলা একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। আমরা প্রশাসন থেকে সবাই আন্তরিক ছিলাম বিষয়টি সমাধানের জন্য। এর জন্য উভয় পক্ষকেই ডেকেছিলাম। আমরা কয়েক দফা মিটিংও করেছিলাম। আলেম সমাজের যে তিনটি দাবি ছিল তার মধ্যে দুইটি দাবি তারা মেনেও নিয়েছিল। শুধু কবর ওপর থেকে নিচে নামানোর জন্য তারা কিছু সময় চেয়েছিল। এই সময়টা আলেম সমাজই তাদের দিয়েছিল। প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমাদের কোনো গ্যাপ ছিল না। তিনটি দাবির মধ্যে দুইটি দাবি পূরণ হওয়ার পরও আলেম সমাজ বিক্ষোভ করতে চেয়েছিল। আমরা আলেম সমাজকে ডেকেছিলিম বিক্ষোভ না করার জন্য। তারা আমাদেরকে ইনশিওর করেছিলেন- কোন ঝামেলা হবে না, শান্তিপূর্ণভাবে তারা বিক্ষোভ করবেন। কিন্তু পরে যা হওয়ার তাতো হয়ে গেছে। এ বিষয়ে আমাদের আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি ছিল না। তারপরও প্রশাসনকে দায় দেওয়া হয়। এটা খুবই দুঃখজনক।
তিনি আরও বলেন, এ ঘটনার সাথে যারা জড়িত তাদেরকে ভিডিও ফুটেজ দেখে শনাক্ত করে ইতোমধ্যেই পুলিশ ২৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে।
উল্লেখ্য, গত ২৩ আগস্ট বার্ধক্যজনিত কারণে মারা যান নুরাল পাগলা। ওই দিন রাতে মাটি থেকে ১২ ফুঁট উঁচুতে গোয়ালন্দ দরবার শরিফে তার মরদেহ দাফন করেন ভক্ত ও পরিবারের সদস্যরা। এরপর থেকেই উত্তেজনা চলছিল স্থানীয় আলেমসহ তৌহিদি জনতার মধ্যে। দরবারের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি দিয়ে করা সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন জেলা ইমাম কমিটি, খেলাফতে মজলিস, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলাম, ইসলামী আন্দোলনসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা। পরে ৫ সেপ্টেম্বর জুমার নামাজের পরপরই নুরাল পাগলার দরবারে হামলা ও আগুন দেওয়া হয়। ওই সময় রাসেল মোল্লা নামে এক ভক্তকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। পরে নুরাল পাগলার মরদেহ কবর থেকে উত্তোলন করে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের পদ্মার মোড়ে নিয় গিয়ে পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)