রবিবার, ১০ আগস্ট ২০২৫, ২৬ শ্রাবণ ১৪৩২


ভারতীয় ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত

ভারতে একের পর এক স্থগিত বিদেশি অর্ডার, চলে যাচ্ছে বাংলাদেশ-পাকিস্তানে

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

প্রকাশিত:১০ আগষ্ট ২০২৫, ১৯:৫৬

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আরোপিত ৫০ শতাংশ শুল্কের প্রভাব ইতোমধ্যে ভারতের তৈরি পোশাক খাতের ওপর পড়তে শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপের বিশ্বের নামিদামী অনেক ব্র্যান্ড তাদের ভারতে পোশাকের অর্ডার স্থগিত অথবা বাংলাদেশ, পাকিস্তান কিংবা ভিয়েতনামের মতো দেশে সরিয়ে নিতে শুরু করেছেন।

রোববার ভারতের ইংরেজি দৈনিক দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ভারতের তৈরি পোশাক খাতে মার্কিন শুল্কের প্রভাব নিয়ে বিস্তারিত এক প্রতিবেদনে প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, ভারতের নিটওয়্যার রাজধানী হিসেবে পরিচিত তামিলনাড়ুরর তিরুপ্পুর রপ্তানিকারকরা ইতোমধ্যে মার্কিন শুল্কের প্রভাব অনুভব করতে শুরু করেছেন।

সেখানকার রপ্তানিকারকরা বলছেন, তৈরি পোশাকের অনেক ক্রেতা দীর্ঘদিন ধরে নতুন নতুন অর্ডার দিয়ে এলেও বর্তমানে তারা অর্ডার স্থগিত করছেন, অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছেন কিংবা বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম এবং কম্বোডিয়ার মতো প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোতে চলে যাচ্ছেন। এসব দেশে মার্কিন শুল্ক হার ভারতের তুলনায় অনেক কম; যা ১৯ থেকে ৩৬ শতাংশের মাঝে রয়েছে।

তিরুপ্পুরের এক রপ্তানিকারক দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেন, তার প্রতিষ্ঠানের নিয়মিত মার্কিন চালান ইতোমধ্যে পাকিস্তানে চলে গেছে। আরেকজন বলেছেন, তার আমেরিকান ক্রেতা গ্রীষ্মকালীন অর্ডার নিশ্চিত করার আগে তাকে ‌‌‘‘অপেক্ষা করতে’’ বলেছেন। তৃতীয় এক রপ্তানিকারক বলেন, আগেই ক্রেতারা ২৫ শতাংশ শুল্ক বৃদ্ধির বোঝা রপ্তানিকারকদের বহন করতে বলছিলেন। আর এখন তা রাতারাতি দ্বিগুণ হয়ে গেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্ক কাঠামোতে ভারতের ওপর মূল শুল্কের পাশাপাশি জরিমানা হিসেবে আরোপিত অতিরিক্ত শুল্কও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। দেশটির কিছু নিটওয়্যার পোশাকের ক্ষেত্রে এই শুল্কের কার্যকর হার ৬৪ শতাংশে পর্যন্ত পৌঁছেছে। এর ফলেআঞ্চলিক প্রতিযোগীদের তুলনায় ভারতীয় পণ্যের দাম ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত বেশি হচ্ছে। শুরুতে মার্কিন এই শুল্ককে বড় ধরনের ধাক্কা মনে হলেও বর্তমানে রপ্তানিকারকদের কাছে তা ‘‘এক প্রকার বাণিজ্যিক অবরোধ’’ হিসেবে হাজির হয়েছে।

দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তামিলনাড়ুর টেক্সটাইল খাত মার্কিন অর্ডারের ক্ষেত্রে যখন ঘুরে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল, ঠিক তখনই নতুন করে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। তামিলনাড়ুর তিরুপ্পুর, কোয়েম্বাটুর ও কারুর এলাকার বিভিন্ন কারখানায় সাড়ে ১২ লাখেরও বেশি শ্রমিক কাজ করেন। কেবল এই তিন এলাকা থেকেই বছরে ৪৫ হাজার কোটি টাকার পোশাক রপ্তানি করা হয়।

মাত্র কয়েক কয়েক সপ্তাহ আগেও ভারত–যুক্তরাজ্য মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) এবং চীন ও মিয়ানমারের ওপর উচ্চ শুল্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতাদের ভারতীয় পণ্যের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পাবে বলে আশা তৈরি হয়েছিল। তামিলনাড়ুর অনেক রপ্তানিকারক চাহিদা মেটাতে নতুন যন্ত্রপাতিতে বিনিয়োগও শুরু করেছিলেন। কিন্তু এখন সেই আশায় গুঁড়েবালি। তাদের স্বপ্ন চাপা পড়ছে যুক্তরাষ্ট্রের বাড়তি শুল্কের নিচে।

তিরুপ্পুরের রপ্তানিকারকদের সংগঠন তিরুপ্পুর এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (টিইএ) সভাপতি কে এম সুব্রাহ্মনিয়ান বলেন, ‘‘এটি বড় ধাক্কা। প্রথমে স্বতন্ত্র রপ্তানিকারক বিভিন্ন কোম্পানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ক্রেতারা ইতোমধ্যে আমাদের শুল্কের অংশ ভাগাভাগি করে নিতে বলছে। আমাদের মুনাফা মাত্র ৫ থেকে ৭ শতাংশ; আমরা কীভাবে এই ব্যয় ভাগাভাগি করব।’’

তিনি বলেন, তিরুপ্পুরের রপ্তানির ৩০ শতাংশই যুক্তরাষ্ট্রে যায়। ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের মতো বহুমুখী ক্রেতা কিছুটা সুরক্ষা দেবে, কিন্তু সেটিও ক্ষতি ছাড়া সম্ভব নয়। ব্র্যান্ডের বাইরে ক্রেতারা শিগগিরই সরে যাবে। আমাদের সামাজিক মানদণ্ড ও কার্যপ্রণালী মেনে চলার কারণে ব্র্যান্ডগুলো থাকতে পারে। কিন্তু তাতেও আমাদের কিছুদিন রক্তক্ষরণ হবে।

টেক্সটাইল শ্রমনির্ভর খাত এবং বাজার সঙ্কুচিত হলে এই খাতে বিপুলসংখ্যক মানুষের চাকরি হারানোর শঙ্কা রয়েছে। রপ্তানি ১০-২০ শতাংশ কমে গেলে আগামী কয়েক মাসে তিরুপ্পুর, কারু ও কোয়েম্বাটুরে টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস খাতের এক থেকে দুই লাখ মানুষের চাকরি হারানোর ঝুঁকি তৈরি হবে।

তামিলনাড়ুর তিরুপ্পুর থেকে কেবল ৪০ হাজার কোটি রুপির নিটওয়্যার রপ্তানি করা হয়। তিরুপ্পুরের কারখানাগুলো ওয়ালমার্ট, গ্যাপ, কস্টকোর মতো বৈশ্বিক জায়ান্টদের কাছে পোশাক সরবরাহ করে এবং দেশের নিটওয়্যার রপ্তানির ৫৫ শতাংশের যোগান দেয়। সেখানকার রপ্তানিকারকরা ২০২৫-২৬ অর্থবছরে রপ্তানি ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বৃদ্ধির প্রত্যাশা করেছিলেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের বাড়তি শুল্ক আরোপের পর এই খাতের বিশ্লেষকরা পূর্বাভাস দিয়ে বলছেন, তুলা ও নিটওয়্যার পোশাক খাতে মার্কিন অর্ডার ৪০-৫০ শতাংশ কমে যেতে পারে।

মার্কিন শুল্কের প্রবাব কেবল পোশাকেই সীমাবদ্ধ নয়। হোম টেক্সটাইলের জন্য বিখ্যাত কোয়েম্বাটুর ও কারুতেও বিদেশি ক্রেতাদের অর্ডার স্থগিত হতে শুরু করেছে। সাউদার্ন ইন্ডিয়া মিলস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব কে সেলভারাজু বলেছেন, ক্রেতারা বিছানার চাদর ও তোয়ালের মতো গ্রীষ্মকালীন পণ্যের অর্ডার স্থগিত কিংবা বিলম্বিত করছেন; যা সাধারণত অক্টোবরের মধ্যেই চূড়ান্ত হয়।

সেলভারাজু বলেন, ‘‘যারা পোশাকের অর্ডারের বিষয়ে অগ্রিম খোঁজ-খবর নিয়েছিল, তারা এখন অপেক্ষা করতে বলছে। এই মৌসুম মিস হয়ে গেলে আর সুযোগ পাওয়া যাবে না।’’

তামিলনাড়ুর কারু থেকেই কেবল বছরে প্রায় ৯ হাজার কোটি রুপির হোম টেক্সটাইল রপ্তানি করা হয়। এর মধ্যে ৬ হাজার ৯০০ কোটি রুপির পোশাক সরাসরি রপ্তানি করা হয়। কোয়েম্বাটুরের কারখানাগুলো বিপুল পরিমাণ তুলার তোয়ালে ও রান্নাঘরের কাপড় যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করে। বর্তমানে এসব বস্ত্রও যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ শুল্কের কবলে পড়েছে।

সেলভারাজু বলেছেন, ‘‘এটি কেবল শুল্ক বৃদ্ধি নয়, বরং ইতোমধ্যে দুর্বল হয়ে যাওয়া পরিবেশকে আরও ভয়াবহ করে তুলেছে।’’ তিনি ভারতের তুলার ওপর ১১ শতাংশ আমদানি শুল্ক এবং জিএসটি-সংক্রান্ত অসঙ্গতির কথাও বলেছেন। এর ফলে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো আরও ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।

তিনি বলেন, পলিয়েস্টার কাঁচামালে ১৮, সুতায় ১২ শতাংশ শুল্ক হলেও তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে তা ৫ শতাংশ। এটি রপ্তানি খরচে আরও ৬ থেকে ৭ শতাংশ যুক্ত করে। যেখানে প্রতিযোগীদের এই ধরনের সমস্যা নেই।

এদিকে, ভারতের বাজারে ব্রাজিল থেকে আমদানি করা তুলার মান নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ব্রাজিল থেকে আমদানি করা তুলা সবসময় মার্কিন মানদণ্ড পূরণ করতে পারে না বলে দেশটির ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছেন। মার্কিন তুলার শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দিয়ে সেই তুলা থেকে তৈরি পোশাকের বিনিময়ে রপ্তানি চুক্তি করার বিষয়ে দেশটির কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন সেলভারাজু।

তিনি বলেন, তৈরি পোশাকের বৈশ্বিক বাজার অত্যন্ত প্রতিযোগিতাপূর্ণ। ভারতের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীরা এমন শাস্তিমূলক মার্কিন শুল্কের মুখোমুখি হয়নি। বাংলাদেশ এখনও ৩৫ থেকে ৩৬ শতাংশ শুল্ক হার বহাল রেখেছে। পাকিস্তান ১৯ শতাংশে নেমে এসেছে, ভিয়েতনাম ২০-২১ শতাংশ এবং কম্বোডিয়া আগে ৪৯ শতাংশ শুল্ক গুনলেও গত ১ আগস্ট থেকে তা ১৯ শতাংশে নেমেছে। সেই তুলনায় ভারতের ৫০ শতাংশ শাস্তিমূলক শুল্ক কেবল বিচ্ছিন্ন কোনও ঘটনাই নয়, বরং নজিরবিহীনও।

তিরুপ্পুরের অপর এক তৈরি পোশাক কারখানা মালিক ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেছেন, তার প্রতিষ্ঠানে আসা বিদেশি ক্রেতাদের অর্ডার ইতোমধ্যে পাকিস্তানে চলে গেছে। তারা সম্ভবত ভালো দাম প্রস্তাব করেছে। অর্ডার হাতছাড়া হয়ে গেছে।

সুব্রাহ্মনিয়ান বলেন, মার্কিন বাজারে ভারতের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী বাংলাদেশ। তাদের ২০ শতাংশ শুল্ক মানে পোশাক অনেক সস্তা। আপনার মুনাফা যখন মাত্র ৫ শতাংশ, তখন এই শুল্ক অনেক বড় বিষয়। ভারতের ক্ষেত্রে বর্তমানে এই মুনাফা কার্যত উধাও হয়ে গেছে। কারণ ভারতের পণ্যে মার্কিন শুল্ক ৬৪ শতাংশ ছুঁয়েছে এবং ব্র্যান্ডের বাইরের মার্কিন ক্রেতারা ইতোমধ্যে সস্তা বিকল্প খুঁজে নিচ্ছে। তারা রাতারাতি সরে যাচ্ছে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন ভারতীয় এই পোশাক রপ্তানিকারক।

তিনি দেশটির তুলা আমদানির ওপর ১১ শতাংশ আমদানি শুল্ক বাতিল ও কৃত্রিম তন্তুর ওপর জিএসটি পর্যালোচনার দাবি জানিয়েছেন। সুব্রাহ্মনিয়ান বলেন, আমাদের রপ্তানি টিকিয়ে রাখতে হলে সব কাঁচামালের ওপর শুল্ক ৫ শতাংশের নিচে রাখতে হবে। বিষয়টি অগ্রাহ্য করা হলে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। ভারত স্থায়ীভাবে বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম ও পাকিস্তানের কাছে মার্কিন বাজার হারাতে পারে। যাদের এখন সব পণ্যের ‘ল্যান্ডেড প্রাইস’ যুক্তরাষ্ট্রে আরও সস্তা। মার্কিন শুল্কের প্রভাব ইতোমধ্যে দেখা যাচ্ছে। আমাদের অর্ডার কমে গেছে, শ্রমিকদের চাকরি হারানোর শঙ্কা তৈরি হয়েছে।।

সেলভারাজু বলেন, মার্কিন বাজার এখনও আমাদের কাছ থেকে কিনতে চায়। তারা ভারতীয় তুলা, ভারতীয় মান পছন্দ করে। কিন্তু রাজনৈতিক ও নীতি-সংক্রান্ত বাধা তাদের দূরে ঠেলে দিচ্ছে।

সূত্র: দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস।

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)
আরো পড়ুন

সর্বশেষ

জনপ্রিয়

নামাজের সময়সূচি

ওয়াক্ত সময়সূচি
ফজর ০৪:১১ ভোর
যোহর ১২:০৪ দুপুর
আছর ০৪:৪০ বিকেল
মাগরিব ০৬.৩৯ সন্ধ্যা
এশা ০৭:৫৭ রাত

রবিবার ১০ আগস্ট ২০২৫