বুধবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ৯ আশ্বিন ১৪৩২


বিবিসির প্রতিবেদন

পাকিস্তান–সৌদি প্রতিরক্ষা চুক্তিতে নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভারত

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

প্রকাশিত:২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৩:৩৮

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

পাকিস্তান ও সৌদি আরবের সদ্যস্বাক্ষরিত প্রতিরক্ষা চুক্তি নিয়ে বাড়ছে ভারতের অস্বস্তি। বিশ্লেষকরা বলছেন, তাৎক্ষণিক সামরিক হুমকি না থাকলেও এই পদক্ষেপ আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্যে নতুন সমীকরণ তৈরি করতে পারে।

মঙ্গলবার (২৩ সেপ্টেম্বর) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।

সংবাদমাধ্যমটি বলছে, গত সপ্তাহে রিয়াদে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ ও সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের আলিঙ্গনের দৃশ্য ছিল বেশ অর্থবহ। আর এই উষ্ণতা আসে দু’দেশের মধ্যে একটি কৌশলগত পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষরের পর।

এর মধ্য দিয়ে ইসলামী বিশ্বের একমাত্র পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রের সঙ্গে উপসাগরের সবচেয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী রাজতন্ত্র আরও ঘনিষ্ঠ হলো। রয়টার্সকে এক জ্যেষ্ঠ সৌদি কর্মকর্তা বলেছিলেন, এ চুক্তি মূলত বহুদিনের গভীর সহযোগিতাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া। কিন্তু ভারতের কাছে এর তাৎপর্য অন্যরকম।

নয়াদিল্লি গত কয়েক বছর ধরে রিয়াদের সঙ্গে সম্পর্ক উষ্ণ রাখলেও পাকিস্তানের সঙ্গে চলমান উত্তেজনার মধ্যে এই পদক্ষেপ দেশটিতে নতুন করে দুশ্চিন্তা বাড়িয়েছে। চলতি বছরের মে মাসে চার দিনের সংঘর্ষসহ কাশ্মির ইস্যুতে পরমাণু অস্ত্রধারী প্রতিবেশী দু’দেশ একাধিকবার যুদ্ধে জড়িয়েছে।

ফলে পাকিস্তানের সামরিক সক্ষমতায় সৌদি আরবের সমর্থন ভারতকে সরাসরি ভাবাচ্ছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো— চুক্তির শর্তে বলা হয়েছে, “যে কোনো এক দেশের ওপর হামলা মানেই উভয় দেশের ওপর হামলা।”

ভারতের কৌশলবিদ ব্রহ্মা চেলানি সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এক্সে (সাবেক টুইটার) লিখেছেন, “রিয়াদ জানত ভারত এই চুক্তিকে নিজেদের নিরাপত্তার প্রতি সরাসরি হুমকি হিসেবে নেবে। তারপরও তারা এগিয়েছে।”

তার মতে, এটি পাকিস্তানের শক্তি নয় বরং সৌদি আরবের উচ্চাকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ। তার ভাষায়, “একজন দীর্ঘমেয়াদি নির্ভরশীল অংশীদারকে সঙ্গে রাখাটা রিয়াদকে জনশক্তি ও পরমাণু ‘বিমা’র নিশ্চয়তা দেবে। একইসঙ্গে তারা ভারত, ওয়াশিংটনসহ অন্যদের জানিয়ে দিলো যে নিজেদের পথ তারা নিজেরাই বেছে নেবে।”

ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব কানওয়াল সিবাল চুক্তিটিকে “গুরুতর ভুল পদক্ষেপ” আখ্যা দিয়ে সতর্ক করেছেন। তিনি বলেছেন, এটি ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার ওপর গুরুতর প্রভাব ফেলতে পারে। তিনি লিখেছেন, “রাজনৈতিকভাবে অস্থির ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল পাকিস্তানকে নিরাপত্তা দাতা বানানো বিপজ্জনক। পাকিস্তান–ভারত উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে সৌদি আরবের এই পদক্ষেপ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।”

তবে নরেন্দ্র মোদি নেতৃত্বাধীন ভারত সরকার এখন পর্যন্ত সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জানিয়েছেন, জাতীয় নিরাপত্তা, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার জন্য এ চুক্তির প্রভাব কী হতে পারে তা খতিয়ে দেখবে সরকার। পাশাপাশি নয়াদিল্লি আশা করছে, ভারত–সৌদি কৌশলগত অংশীদারত্বে উভয়পক্ষের পারস্পরিক স্বার্থ ও সংবেদনশীলতা বিবেচনা করা হবে।

সব বিশ্লেষক অবশ্য একে বিপজ্জনক মনে করছেন না। তাদের মতে, দিল্লি হয়তো ঝুঁকিকে বাড়িয়ে দেখাচ্ছে। কারণ সৌদি আরব ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ককেই প্রাধান্য দেয়। ভারত সৌদির দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার ও জ্বালানি আমদানিকারক দেশ।

পররাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যান বিবিসিকে বলেছেন, এ চুক্তি সরাসরি কোনোভাবে ভারতকে বাধাগ্রস্ত করছে না। তিনি বলছেন, “সৌদি আরবের ভারতের সঙ্গে সুদৃঢ় সম্পর্ক রয়েছে, তারা ভারতের বিরুদ্ধে কোনো শত্রুভাবাপন্ন পদক্ষেপ নেবে না।”

তবে তার মতে, পাকিস্তানকে মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা কাঠামোর ভেতরে টেনে এনে সৌদি আরব কার্যত ভারতকে ‘চেকমেট’ করেছে। এখন পাকিস্তানের পাশে দাঁড়িয়েছে চীন, তুরস্ক এবং সৌদি আরব— যারা সাম্প্রতিক সংঘাতে পাকিস্তানকে অস্ত্রও দিয়েছে।

অন্যদিকে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এই চুক্তির তাৎপর্য ভারতের জন্য তাৎক্ষণিক সামরিক হুমকির চেয়ে বরং আঞ্চলিক জোট–সমীকরণে পরিবর্তন আনবে।

ওয়াশিংটনভিত্তিক হাডসন ইনস্টিটিউটের গবেষক ও সাবেক পাকিস্তানি কূটনীতিক হুসেইন হক্কানি বিবিসিকে বলেছেন, ভারতের উদ্বেগ “বহুমাত্রিক”। তার মতে, এ চুক্তি পাকিস্তানকে সেই অবস্থানে নিতে পারে যেভাবে শীতল যুদ্ধকালে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়েছিল— অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের সামরিক সক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করবে ওয়াশিংটন।

তিনি সতর্ক করেছেন, “আসলে বিষয়টা নির্ভর করবে ‘আগ্রাসন’ ও ‘আগ্রাসী’ শব্দের সংজ্ঞায় রিয়াদ ও ইসলামাবাদের অবস্থান এক হয় কি না”। একইসঙ্গে তিনি মনে করেন, এর ফলে ভারত–সৌদি অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্কও চাপে পড়তে পারে।

অন্যদিকে দিল্লির জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মো. মুদ্দাসসির কওমার মনে করেন, সদ্যস্বাক্ষরিত প্রতিরক্ষা চুক্তি নতুন কিছু নয়, বরং ১৯৬০-এর দশক থেকে চালু থাকা সৌদি–পাকিস্তান সম্পর্কেরই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ।

তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, পাকিস্তানি সেনা মোতায়েন, ১৯৭৯ সালে মক্কা মসজিদ দখল ঠেকাতে কমান্ডো পাঠানো, সৌদি বিমান বাহিনী গড়তে পাকিস্তানি অফিসারদের সহায়তা— সবই এর অংশ। এমনকি ২০১৭ সালে সৌদি-সমর্থিত আইএসবিরোধী জোটে একজন অবসরপ্রাপ্ত পাকিস্তানি সেনাপ্রধানকে নেতৃত্ব দিয়েছিল রিয়াদ।

হক্কানির মতে, ১৯৭০-এর দশক থেকেই পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক সহায়তা, তেলের অর্থপ্রদান বিলম্বিত করার সুযোগ এবং সামরিক অংশীদারত্বের মাধ্যমে ইসলামাবাদকে পাশে রেখেছে রিয়াদ।

এ ছাড়া সাম্প্রতিক ভূরাজনৈতিক বাস্তবতাও ভূমিকা রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা ছাতার ওপর আস্থা কমে যাওয়া এবং ইরান ও ইসরায়েলকে নিয়ে উদ্বেগ বাড়তে থাকায় সৌদি আরব এখন বহুমুখী নিরাপত্তা অংশীদারত্ব খুঁজছে।

চ্যাথাম হাউসের গবেষক আহমেদ আবুদুহের মতে, এই চুক্তি মূলত এমন সংকেত দেওয়ার জন্যই করা হয়েছে যে সৌদি এখন নিরাপত্তা সহযোগিতায় বৈচিত্র্য আনছে, তবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ঝুঁকিতে ফেলছে না। তার মতে, এ চুক্তি রিয়াদের হুমকি – ধারণার পরিবর্তনকেও তুলে ধরে — যেখানে ইরান ও ইসরায়েলকে হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে, আর পাকিস্তানের পরমাণু সক্ষমতাকে প্রতিরোধশক্তি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

অবশ্য পাকিস্তান ও সৌদি আরবের সদ্যস্বাক্ষরিত প্রতিরক্ষা চুক্তির পর ভারতের জন্য আসল ঝুঁকি সামরিক নয়, বরং ভূরাজনৈতিক। আবুদুহ সতর্ক করেছেন, বিস্তৃত জোট একসময় “ইসলামিক ন্যাটো”-তে রূপ নিতে পারে, যা ভারতের ‘লুক ওয়েস্ট’ নীতি — বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও কৌশলগত করিডোর — বাধাগ্রস্ত করবে।

পাকিস্তানের জন্য এ চুক্তি সৌদির আর্থিক শক্তি কাজে লাগিয়ে সামরিক সক্ষমতা বাড়ানোর সুযোগ এবং মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিক সমর্থন টেনে আনার কৌশল। ফলে শুধু পাকিস্তানকে নয়, ভারতকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে বরং বৃহত্তর জোটকেও।

কুগেলম্যান মনে করেন, এ চুক্তি আঞ্চলিক ভারসাম্য পাকিস্তানের দিকে সরিয়ে দিয়েছে। ভারত আনুষ্ঠানিক সামরিক জোটে না গেলেও রাশিয়া, ইসরায়েল, উপসাগরীয় দেশগুলো ও পশ্চিমা মিত্রদের (ফ্রান্সসহ) ঘনিষ্ঠতা কাজে লাগাতে হবে। তবে চ্যালেঞ্জটা পাকিস্তানের শক্তি বৃদ্ধিতে, ভারতের দুর্বলতায় নয়।

এছাড়া তাৎক্ষণিক নিরাপত্তা হুমকি না থাকলেও বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, কূটনৈতিকভাবে নয়াদিল্লির জন্য এটি ভালো সংকেত নয়। শেষ পর্যন্ত কীভাবে পরিস্থিতি গড়াবে তা এখনো অনিশ্চিত, তবে ভারত বিষয়টিকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করবে।

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)
আরো পড়ুন

সর্বশেষ

জনপ্রিয়

নামাজের সময়সূচি

ওয়াক্ত সময়সূচি
ফজর ০৪:৩১ ভোর
যোহর ১১:৫২ দুপুর
আছর ০৪:১৫ বিকেল
মাগরিব ০৫.৫৯ সন্ধ্যা
এশা ০৭:১২ রাত

বুধবার ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫