মঙ্গলবার, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৫ আশ্বিন ১৪৩২
ফাইল ছবি
পাকিস্তানের একটি সশস্ত্র সংগঠনের হয়ে গত ছয় মাসে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ের সময় দুই বাংলাদেশি তরুণের মৃত্যুর খবর গণমাধ্যমে এসেছে। ওই সংগঠনের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে দু’জনকে গত জুলাইয়ে আটক করে বাংলাদেশ পুলিশ। ফলে কীভাবে বাংলাদেশের তরুণরা পাকিস্তানের এসব গোষ্ঠীর সঙ্গে জড়াচ্ছে সেই প্রশ্ন সামনে আসছে।
পাকিস্তানে সামরিক বাহিনীর অভিযানে গত শুক্রবার সশস্ত্র সংগঠন তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানের (টিটিপি) ১৭ সদস্য নিহত হওয়ার খবর প্রকাশিত হয় গণমাধ্যমে, তাদের মধ্যে বাংলাদেশি একজন তরুণকেও শনাক্ত করা হয়েছে। তার নাম ফয়সাল, বাড়ি মাদারীপুরে।
এর আগে, গত এপ্রিলে দেশটির উত্তর ওয়াজিরিস্তানে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে আহমেদ জুবায়ের নামে আরেকজন বাংলাদেশির নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গিয়েছিল। এছাড়া পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে টিটিপির সঙ্গে সম্পৃক্ত সন্দেহে দু’জনকে গত জুলাইয়ে আটক করে বাংলাদেশের পুলিশ।
জঙ্গি বিষয়ে কাজ করে ঢাকায় পুলিশের এমন কিছু সূত্র বলছে, টিটিপির জন্য বাংলাদেশ থেকে জনবল সংগ্রহ করার একটি প্রক্রিয়া অনেক দিন ধরেই সক্রিয় আছে, যার নেতৃত্বে আছেন ইঞ্জিনিয়ার ইমরান হায়দার নামের এক ব্যক্তি। গত জুলাইয়ে পুলিশেরই দায়ের করা একটি মামলার এজাহারে এই তথ্য পাওয়া যায়।
বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে জঙ্গি সংগঠনগুলোর তৎপরতার দিকে যারা নজর রাখেন তারা বলছেন, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান-ভিত্তিক জঙ্গি সংগঠনগুলোর সাথে বাংলাদেশি জঙ্গিদের সম্পৃক্ত হওয়ার বিষয়টি নতুন নয়। কেউ কেউ বলছেন, বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে মুজাহিদ রিক্রুটমেন্টের মতো ঘটনাও ঘটেছে।
এছাড়া বাংলাদেশে সক্রিয় জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কীয়া নামের একটি জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে আল-কায়েদার যোগসূত্র আছে বলেও পুলিশ ও জঙ্গি বিষয়ক গবেষকরা বলে থাকেন। আল-কায়েদার সাথে আবার যোগসূত্র আছে টিটিপির।
পুলিশের একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা বলেছেন, টিটিপির সঙ্গে সম্পৃক্ত এমন দু’জনকে গত জুলাইয়ে আটকের পর বাংলাদেশের ভেতরে এর নেটওয়ার্ক সম্পর্কে আরও তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে।
টিটিপি মূলত পাকিস্তানের পাঠান মাদ্রাসা ছাত্রদের বিভিন্ন সংগঠনের একটি জোট। ২০০৭ সালে বাইতুল্লাহ মেহ্সুদের নেতৃত্বে ১৩টি সংগঠন মিলে টিটিপি গঠিত হয়। জোট গঠনের পর থেকেই টিটিপির মধ্যে দলীয় কোন্দল শুরু হয় এবং এর জেরে বেশ কয়েকটি উপদল তৈরি হয়। তবে ২০২০ সালে টিটিপি আবার এক হয়। তারা পাকিস্তানে ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
পাকিস্তানে কয়েকটি বড় ধরনের হামলার ঘটনায় বিভিন্ন সময়ে এ সংগঠনটির নাম সামনে এসেছে। সংগঠনটি পাকিস্তানের বাইরে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশ থেকে তাদের জিহাদি সদস্য রিক্রুট করে থাকে বলে মনে করা হয়।
পাকিস্তানে বিভিন্ন সময়ে মসজিদ ও স্কুলসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে হামলার জন্য টিটিপিকে দায়ী করা হয়। তাদের হামলায় সেনা সদস্য নিহত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। পাকিস্তান সরকার ২০১৪ সালে টিটিপির সাথে শান্তি আলোচনার উদ্যোগ নিলে তখন তা সমালোচনার মুখে পড়েছিল।
এর মধ্যেই গত ছয় মাসে পাকিস্তানে দু’জন বাংলাদেশি তরুণ, যারা টিটিপির সদস্য বলে ধারণা করা হচ্ছে, তাদের মৃত্যুর খবর সামনে এলো। বাংলাদেশে জঙ্গি কার্যক্রম বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে নজর রাখছেন মানবাধিকার সংগঠক নূর খান লিটন। তার মতে, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান ভিত্তিক জঙ্গি সংগঠনগুলোর সাথে বাংলাদেশিদের সম্পৃক্ত হওয়ার বিষয়টি অনেক পুরোনো।
‘‘এমনকি বায়তুল মোকাররমের কাছে ব্যানার দিয়ে মুজাহিদ সংগ্রহের তৎপরতা দেখেছি আমরা। বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশ্যেও এ ধরনের রিক্রুটমেন্টের নজির আছে। তবে এখন অনেকটা নিয়ন্ত্রণে তাদের কার্যক্রম। কিন্তু পুরোপুরি যে বন্ধ হয়নি সেটি পাকিস্তানে দু’জনের নিহত হওয়ার ঘটনায় প্রমাণিত হলো।’’
বাংলাদেশে টিটিপির কার্যক্রমে জড়িতদের মধ্যে যারা আটক হয়েছে তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশের একটি সূত্র বলছে, বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরব কিংবা দুবাই হয়ে আফগানিস্তান কিংবা পাকিস্তানে পৌঁছায় টিটিপি নেটওয়ার্কের সদস্যরা।
পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কিছুদিন ধরে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে তাদের চ্যানেলে এসব বিষয়ে তথ্য সরবরাহ করে আসছিল। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই গত জুলাইয়ে বাংলাদেশের পুলিশ টিটিপির সাথে সম্পৃক্ত সন্দেহে দু’জনকে আটক করতে পেরেছিল বলে পুলিশের শীর্ষস্থানীয় একজন কর্মকর্তা তখন বলেছিলেন।
এর মধ্যে একজনকে গত ২ জুলাই ঢাকার কাছে সাভার থেকে এবং অন্যজনকে ১৪ জুলাই নারায়ণগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট। তাদের দু’জনের বিরুদ্ধেই টিটিপির সাথে যোগসূত্র থাকার অভিযোগ আনা হয়।
আটক হয়ে কারাগারে যাওয়া ওই দু’জনের মধ্যে একজনকে আগেও পুলিশ জঙ্গি কার্যক্রমে সক্রিয় থাকার অভিযোগে আটক করেছিল। ২০২৩ সালে র্যাব জানিয়েছিল, তিনি জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কীয়া নামে একটি জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে জড়িত।
এপ্রিলে পাকিস্তানের উত্তর ওয়াজিরিস্তানে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে জুবায়ের নামে এক বাংলাদেশির নিহত হওয়ার তথ্য পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ প্রকাশ করেছিল। দেশটির আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) বরাত দিয়ে খবরে বলা হয়েছিল, উত্তর ওয়াজিরিস্তানের রাজমাক এলাকায় গোয়েন্দা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ওই অভিযান চালানো হয়।
এর বাইরে তখন আরও অন্তত ৩৫ জন বাংলাদেশিকে বালোচিস্তান থেকে আটক করার তথ্য নিরাপত্তা বাহিনীর বরাতে পাকিস্তানের সংবাদ মাধ্যমে এসেছিল। বাংলাদেশে টিটিপির সাথে সম্পৃক্ত সন্দেহে একজনকে গত ২ জুলাই রাত ৯টার দিকে সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স মোড়ে একটি দোকান থেকে আটক করে পুলিশের অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট। আটকের পরদিন তাকে আদালতে উপস্থাপন করলে আদালত তাকে কারাগারে পাঠায়।
পরে সেই ব্যক্তিসহ ছয়জন ও তাদের অজ্ঞাতনামা সহযোগীদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে নিয়মিত মামলা হয়। টিটিপির সদস্য সন্দেহে আরেকজনকে গত ১৪ জুলাই নারায়ণগঞ্জ থেকে আটক করে অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিটের কাছে হস্তান্তর করে র্যাব। এরপর তাকেও প্রথমজনের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
মামলায় দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, আটক দু’জন ২০২৪ সালের ১৮ অক্টোবর ঢাকা ছেড়েছিলেন। কিন্তু ওমরাহ না করে তারা পরদিনই সৌদি আরব থেকে পাকিস্তানে যান। সেখান থেকে ৬ নভেম্বর তুরখান সীমান্ত দিয়ে আফগানিস্তানে প্রবেশ করেন।
একদিন পর ওই একই সীমান্ত দিয়ে তাদের একজন আবার পাকিস্তানে আসেন। এরপর করাচি থেকে দুবাই হয়ে ১৬ নভেম্বর তিনি দেশে ফেরেন। কিন্তু তার সহযোগী অপর বাংলাদেশি পরে উত্তর ওয়াজিরিস্তানে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে নিহত হন, যার নাম আহমেদ জুবায়ের ওরফে যুবরাজ।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আটক একজন পুলিশকে এই তথ্য জানিয়েছে বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে। মামলার এজাহারে আরও কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে বলা হয়েছে, তারাও ধর্মীয় উগ্রবাদী দীক্ষিত হয়ে জিহাদের জন্য প্রস্তুত রয়েছে।
এই মামলার এজাহারেই বলা হয়, ইঞ্জিনিয়ার ইমরান হায়দার নামে এক বাংলাদেশি টিটিপির হয়ে বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনা করে। মূলত তিনি ওই সংগঠনের হয়ে যুদ্ধে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করেন ও সদস্যদের সংঘবদ্ধ করার ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করেন। উক্ত আসামি বাংলাদেশে টিটিপির সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধির কার্যক্রম, সদস্যদের ইসলামী খিলাফতের দাওয়াত পৌঁছানোর কার্যক্রম পরিচালনা এবং ধর্মীয় উগ্রবাদ ও সন্ত্রাসবাদে উদ্বুদ্ধ করছে বলে মামলায় বলা হয়েছে।
জুবায়েরের সঙ্গী যিনি পুলিশের হাতে আটক হন, পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাদে তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই দ্বিতীয় জনকে আটক করা হয় বলে পুলিশের সূত্রগুলো জানিয়েছে। কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, এ ঘটনার পর পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছে এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য বিনিময় করা হয়েছে।
এর ভিত্তিতেই নতুন করে গোয়েন্দা কার্যক্রম শুরু হয় বাংলাদেশে। এর ধারাবাহিকতায় জুলাইয়ে দু’জনকে আটক করা হয়েছে। মামলার এজাহারে আরও যাদের নাম দেওয়া হয়েছে তাদেরও আটকের চেষ্টা করছে পুলিশ।
ধারণা করা হয়, টিটিপির জন্য জনবল সংগ্রহে কাজ করছিল আটক ব্যক্তিদের একজন এবং তার সংগঠন। তারাই লোক বাছাই করে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দিয়ে সৌদি আরব বা দুবাই হয়ে পাকিস্তানে টিটিপির নেটওয়ার্কে লোক পাঠায় বলে পুলিশ সূত্রগুলোরও ধারণা। ২০২৩ সালের ২৩ জুন এই ব্যক্তি ও তার স্ত্রীকে ঢাকার ডেমরা থেকে অস্ত্রসহ আটক করেছিল তখনকার কাউন্টার টেরোরিজিম ইউনিট। তখন তাকে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে দাবি করেছিল পুলিশ। বিবিসি বাংলা।
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)