মঙ্গলবার, ১২ আগস্ট ২০২৫, ২৮ শ্রাবণ ১৪৩২


আমরা কি অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছি?

ড. সুলতান মাহমুদ রানা

প্রকাশিত:১২ আগষ্ট ২০২৫, ১০:১৯

ছবি সংগৃহীত

ছবি সংগৃহীত

বিশ্বায়নের এই যুগে আমরা ক্রমেই যোগাযোগের নেটওয়ার্কে আবদ্ধ হচ্ছি। ভৌগোলিক দূরত্ব সঙ্কুচিত হচ্ছে। সংস্কৃতি, ভাষা ও চিন্তাধারার বিনিময় বেড়ে চলেছে। তবুও এক অদ্ভুত বৈপরীত্য চোখে পড়ে-প্রযুক্তি ও জ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সমাজে অসহিষ্ণুতার প্রকাশও যেন বেড়ে যাচ্ছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘৃণাবাচক মন্তব্য, রাজনৈতিক মতভেদে শত্রুতা, ধর্মীয় ও জাতিগত পরিচয়ে বৈষম্য-এসবই প্রশ্ন তোলে, আমরা কি জাতিগতভাবে অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছি?

সহিষ্ণুতা (Tolerance) শুধু নৈতিক গুণ নয়, এটি একটি সভ্য সমাজের টিকে থাকার শর্ত। ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ার (Voltaire) একবার বলেছিলেন, ‘I disapprove of what you say, but I will defend to the death your right to say it.’

অর্থাৎ মতের ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও অন্যের মত প্রকাশের অধিকারকে রক্ষা করা। জাতিগত, ধর্মীয়, রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক পার্থক্য সত্ত্বেও সহিষ্ণু আচরণই একটি জাতিকে সভ্যতার উচ্চ শিখরে পৌঁছে দেয়।

ব্রিটিশ দার্শনিক জন স্টুয়ার্ট মিল (John Stuart Mill) তাঁর বই On Liberty (1859)-এ বলেছেন, ‘Genuine tolerance is not about indifference; it is about valuing diversity as a source of societal strength.’

অর্থাৎ, সহিষ্ণুতা মানে উদাসীন থাকা নয়, বরং বৈচিত্র্যকে সমাজের শক্তি হিসেবে মূল্যায়ন করা। এমনকি মহাত্মা গান্ধী উল্লেখ করেন, ‘Our ability to reach unity in diversity will be the beauty and the test of our civilization.’

আমরা যদি উন্নত বিশ্বের দিকে তাকাই, দেখতে পাবো-সহিষ্ণুতা রাতারাতি জন্মায়নি, বরং এটি দীর্ঘ রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চর্চার ফল। উদাহরণস্বরূপ আমরা প্রথমেই কানাডার কথা বলতে পারি।
এখানে তিনি বলেন, বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠাই সভ্যতার সৌন্দর্য ও পরীক্ষার আসল মাপকাঠি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে নানা জরিপ, যেমন Pew Research Center বা World Values Survey, দেখাচ্ছে যে অনেক দেশে জাতিগত, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিভাজন গভীর হচ্ছে।

এর অন্যতম কারণ হলো ভয়ের রাজনীতি, তথ্যবিকৃতি এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা। যখন একটি জাতি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, তখন তারা ভিন্ন পরিচয়ধারীদের প্রতি সন্দেহপ্রবণ হয়ে ওঠে। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন (Amartya Sen) তার Identity and Violence (2006)-এ যুক্তি দেন, “A person’s identity is never singular; intolerance grows when we reduce people to only one dimension of who they are.” অর্থাৎ মানুষকে কেবল এক পরিচয়ে সীমাবদ্ধ করে দেখার চেষ্টা থেকেই অসহিষ্ণুতা জন্মায়।

এই প্রসঙ্গে রাজনৈতিক দার্শনিক আইজাহ বার্লিন (Isaiah Berlin) তার Value Pluralism তত্ত্বে বলেন, “In a world of different values, the task is not to force them into one mold but to create a space where they can coexist.” অর্থাৎ, ভিন্ন মূল্যবোধকে এক ছাঁচে ফেলতে গেলে সংঘাত বাড়ে বরং তাদের সহাবস্থানের জন্য জায়গা তৈরি করাই আসল কাজ।

এখানে সরকারি নীতি অনুযায়ী অভিবাসীদের সাংস্কৃতিক পরিচয় সংরক্ষণের পাশাপাশি মূলধারার সমাজে অন্তর্ভুক্তির সুযোগ দেওয়া হয়। শিক্ষা ব্যবস্থায় বহুসংস্কৃতি শিক্ষা বাধ্যতামূলক। ছোটবেলা থেকেই শিশুদের শেখানো হয় কীভাবে ভিন্ন মতকে সম্মান করতে হয়।

এরপর আমরা নেদারল্যান্ডসের উদাহরণ তুলতে পারি। নেদারল্যান্ডস বহু দশক ধরে liberal tolerance-এর উদাহরণ। ধর্মীয় স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং সমলিঙ্গ বিবাহসহ নানা উদারনীতিতে তারা বিশ্বে শীর্ষে। এখানে সরকার কেবল আইন প্রণয়নেই নয় বরং জনমত গঠনে শিক্ষা, গণমাধ্যম ও নাগরিক অংশগ্রহণকে কাজে লাগায়।

এরপর আসি নিউজিল্যান্ডের কথায়। সেখানে আদিবাসী মাওরি জনগোষ্ঠী ও ইউরোপীয় বংশোদ্ভূতদের মধ্যে ইতিহাসে সংঘাত থাকলেও বর্তমানে একীভূত সামাজিক কাঠামো গড়ে উঠেছে। সরকার মাওরি ভাষা ও সংস্কৃতিকে জাতীয় পরিচয়ের অংশ হিসেবে তুলে ধরেছে। ফলে জাতিগত সমতা কেবল স্লোগানে নয়, বাস্তবনীতিতেও প্রতিফলিত হয়েছে।

এছাড়া সুইডেন, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক প্রভৃতি দেশগুলোয় উচ্চমানের সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা, সমতা-ভিত্তিক শিক্ষা এবং রাজনৈতিক স্বচ্ছতা সহিষ্ণুতার ভিত্তি গড়ে তুলেছে। অর্থনৈতিক বৈষম্য কম থাকায় মানুষ একে অপরকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখে না, বরং সহযোগী হিসেবে দেখে।

সহিষ্ণুতার জন্য কোনো একক ফর্মুলা নেই। তবে উন্নত বিশ্বের অভিজ্ঞতা থেকে কিছু কার্যকর পদ্ধতি নির্ধারণ করা যায়—

(১) ছোটবেলা থেকেই পাঠ্যপুস্তকে ভিন্ন মত, ভিন্ন সংস্কৃতি এবং মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধার শিক্ষা থাকতে হবে। শুধু ইতিহাস বা নাগরিক শিক্ষা নয়, ভাষা, সাহিত্য, এমনকি বিজ্ঞান ক্লাসেও অন্তর্ভুক্তিমূলক উদাহরণ তুলে ধরা যেতে পারে;

(২) অর্থনৈতিক বৈষম্য অসহিষ্ণুতার বড় উৎস। কর্মসংস্থান, সামাজিক সুরক্ষা এবং ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা গেলে মানুষের মধ্যে হিংসা ও অবিশ্বাস কমে যায়;

(৩) সহিষ্ণুতাকে উৎসাহিত করার জন্য বৈষম্য-বিরোধী আইন কার্যকর হতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রে Civil Rights Act বা দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবৈষম্য পরবর্তী সংবিধান- এসবই প্রমাণ করে যে আইন সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হতে পারে।

আলবার্ট আইনস্টাইন যেমন বলেছেন, “Laws alone cannot secure freedom of expression; in order that every man present his views without penalty there must be a spirit of tolerance in the entire population.” অর্থাৎ শুধু আইন দিয়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা সম্ভব নয়- জনগণের মধ্যে সহিষ্ণুতার মানসিকতাও থাকতে হবে;

(৪) সহিঞ্চুতা মূলত শেখাতে হয়, চর্চার বিষয়ও। দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবৈষম্য পরবর্তী পুনর্মিলনের অভিজ্ঞতা থেকে নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছিলেন, “No one is born hating another person because of the color of his skin, or his background, or his religion. People learn to hate, and if they can learn to hate, they can be taught to love.” এটি প্রমাণ করে সহিষ্ণুতা শেখানো সম্ভব, যেমন ঘৃণাও শেখানো হয়।;

(৫) যখন নাগরিকরা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, স্বচ্ছ নির্বাচন এবং অংশগ্রহণমূলক নীতি প্রণয়নের সুযোগ পান, তখন তারা ভিন্নমতকে সহজভাবে গ্রহণ করেন;

(৬) গণমাধ্যম যদি বিভাজনমূলক বক্তব্য প্রচারের পরিবর্তে সহাবস্থানের গল্প তুলে ধরে, তবে তা জনমানসে সহিষ্ণুতার বীজ বপন করে। উদাহরণস্বরূপ, BBC বা Al Jazeera প্রায়শই আন্তঃসাংস্কৃতিক সাফল্যের গল্প প্রচার করে; এবং

(৭) আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী বিনিময় কর্মসূচি, সাংস্কৃতিক উৎসব ও আন্তঃধর্মীয় সংলাপ সহিষ্ণুতার ক্ষেত্র প্রশস্ত করে। এজন্য শিক্ষা বিনিময় এবং সাংস্কৃতিক চিন্তা-চেতনার বিনিময়ও খুব গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশের ইতিহাসে সহিষ্ণুতার বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, জুলাই-আগস্টের আন্দোলন- সবই বহুত্ববাদী চেতনার অংশ ছিল। তবে সাম্প্রতিক সময়ের রাজনৈতিক বিভাজন, ধর্মীয় বিদ্বেষ এবং সোশ্যাল মিডিয়ার অপব্যবহার সমাজে অসহিষ্ণুতা বাড়াচ্ছে। আমাদের চ্যালেঞ্জ হলো, অতীতের সহাবস্থানের ঐতিহ্যকে পুনর্জীবিত করা এবং আধুনিক পদ্ধতিতে তা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া।

সহিষ্ণুতা একটি জাতির মানসিক স্বাস্থ্য। এটি শুধু নৈতিকতার প্রশ্ন নয়, বরং অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতির স্থিতিশীলতার সাথে জড়িত। উন্নত বিশ্বের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে-সহিষ্ণুতা গড়ে তোলা সম্ভব, যদি শিক্ষা, নীতি এবং সামাজিক কাঠামো মিলিতভাবে কাজ করে।

মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র যেমন সতর্ক করেছিলেন, “We must learn to live together as brothers or perish together as fools.”

আমাদেরও যদি জাতিগত, ধর্মীয়, ও রাজনৈতিক পার্থক্যকে শত্রুতার বদলে শক্তি হিসেবে গ্রহণ করতে হয়, তবে এখনই সময় সহিষ্ণুতার পথে যাত্রা শুরুর।

ড. সুলতান মাহমুদ রানা : অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

সম্পর্কিত বিষয়:

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)
আরো পড়ুন

সর্বশেষ

জনপ্রিয়

নামাজের সময়সূচি

ওয়াক্ত সময়সূচি
ফজর ০৪:১২ ভোর
যোহর ১২:০৪ দুপুর
আছর ০৪:৪০ বিকেল
মাগরিব ০৬.৩৮ সন্ধ্যা
এশা ০৭:৫৫ রাত

মঙ্গলবার ১২ আগস্ট ২০২৫