বুধবার, ৯ জুলাই ২০২৫, ২৫ আষাঢ় ১৪৩২
ছবি সংগৃহীত
খাঁচায় বন্দি পাখি দেখা যায় হরহামেশাই। তবে লোহার খাঁচায় এবার বন্দি অবস্থায় দেখা গেল তিন মানব শিশু। খাঁচার ওপরে ছাউনি দেওয়া আর নিচে চাকা লাগানো এক ধরনের গাড়িতে তিন শিশু সন্তানকে নিয়ে রাস্তায় নেমেছেন এক অসহায় মা। মলিন পোশাক, চোখে-মুখে বিষণ্ণতার ছাপ আর দু’চোখে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন দু’মুঠো খাবারের সন্ধানে। সঙ্গে রয়েছে তিন বছরের আরকেটি শিশু কন্যা। মায়ের কষ্টের ভাগ নিতে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে বিশাল ওজনের লোহার খাঁচাযুক্ত গাড়িটি সেও ঠেলছে। এমন করুণ এক দৃশ্যের দেখা মিলেছে ঠাকুরগাঁওয়ের সড়কে।
১৩ মাস বয়সী এক সঙ্গে জন্ম নেওয়া তিন শিশু আব্দুল্লাহ, আমেনা ও আয়শা এবং ৩ বছর বয়সী মরিয়মসহ ৪ শিশু সন্তানের জননী জান্নাত বেগম (২৮)। তিনি বছর পাঁচকে আগে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে বিয়ে করেন চল্লিশ বছর বয়সী হাবিলকে। বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে চলে আসেন ঠাকুরগাঁওয়ে। এ শহরে নিজেদের জায়গায় জমি তো দূরে থাক রাত্রীযাপনের ঘরটুকুও নেই তাদের। পৌর শহরের পরিষদ পাড়া এলাকায় শ্যামল নামে একব্যক্তির ভাড়া বাড়িতে ওঠেন। এরপর শুরু হয় তাদের সংসার। শুরুর কিছুদিন সংসার ভালোই চলছিল। প্রথমে এক কন্যা সন্তানের পর এক সঙ্গে তিন সন্তানের মা হন জান্নাত। হঠাৎ তার সুখের সংসার যেন এক অমাবস্যার রাত নেমে আসে। স্ত্রী সন্তানকে ফেলে নিরুদ্দেশ হয়ে যান হাবিল। এরপর থেকেই ৪ সন্তানকে নিয়ে বিপাকে পড়েন জান্নাত বেগম। শিশুদের রেখে কোথাও কাজ করারও উপায় ছিল না তার। ঠাকুরগাঁওয়ে জান্নাতের কেউ নেই। জান্নাত ও হাবিল এসেছেন ময়মনসিংহ থেকে।
অভাবের সংসারে একাই সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছিলেন জান্নাত। আত্মহত্যার সিন্ধান্ত নেন। আবার আত্মহত্যা করলে বাচ্চাদের কে দেখবে এই ভেবে সেই সিদ্ধান্ত থেকেও সরে আসেন। কি করবে ভেবে পাচ্ছিলেন না। তাই কিডনি বিক্রি করতে গেলে ডাক্তার বলেন, কিডনি বিক্রি করলে দুর্বল হয়ে পড়বেন। তখন সন্তানদের কিভাবে টানবেন? এরপর থেকে একটি লোহার খাচা বানিয়ে তার ভেতরে সন্তানদের নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে সাহায্য তোলেন জান্নাত। সারাদিন রাস্তায় ঘুরে যা পান তা প্রয়োজনের তুলনায় সামান্য।
খাঁচায় বন্দি চার সন্তানকে নিয়ে মায়ের সংগ্রামী জীবন এমন একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে শুকনা খাবার নিয়ে জান্নাতের বাড়িতে যান জেলা প্রশাসনের কয়েকজন কর্মকর্তা। সাহায্যের কথা শুনে জান্নাত বেগমের স্বামী হাবিল বাড়ি ফিরে আসেন। তার বাড়িতে আসা টের পেয়ে স্থানীয়রা ক্ষুব্ধ হয়ে হাবিলকে শাসিয়েছেন।
স্থানীয়দের দাবি, হাবিল অলস, কোনো কাজ করে না। সামান্য বিষয়ে স্ত্রীকে নির্যাতন করেন। কেউ সাহায্য করলে সেগুলো কয়েকদিন খেয়ে আবার নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। সেজন্য স্থানীয়রা ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে শাসন করেছে। হাবিল আর স্ত্রী-সন্তানদের ফেলে যাবেন না বলে এলাকাবাসীকে প্রতিশ্রুতি দেন।
প্রতিবেশীরা বলেন, বাচ্চাগুলোর বাবা থাকতেও বাবা নেই। আর বাড়িতে থাকলে সামান্য বিষয় নিয়ে স্ত্রীকে নির্যাতন করে। কয়েকদিন থেকে চলে যায়। তার বাচ্চা কি খেল না খেল তার কোনো চিন্তা নেই। তার স্ত্রী অন্যের বাড়িতে থেকে খাবার নিয়ে গেলে তা হাবিল খেয়ে নেয়। স্ত্রীকে মারধর করে ঘরের আসবাপত্রও বিক্রি করে দিছে হাবিল। তাই নিরুপায় হয়েই এই পথ বেছে নেন জান্নাত।
রুবেল রানা নামে এক প্রতিবেশী বলেন, চার শিশু সন্তান নিয়ে খুবই মানবেতর জীবন-যাপন করছে জান্নাত। স্বামী হাবিল তাকে ছেড়ে চলে গেছে তার দ্বিতীয় স্ত্রীর কাছে। মাঝে-মধ্যে আসে আবার চলে যায়। অনেক সময় বাচ্চাদের খাবার দিতে পারে না সে। তাই সে বাধ্য হয়ে এ পথে নেমেছে। এরই মধ্যে জেলা প্রশাসনের পক্ষে থেকে কিছু শুকনো খাবার দিয়ে গেছে। যা দিয়ে কিছু দিন চলতে পারবে।
তিনি আরও বলেন, জান্নাত বাচ্চাদের নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকেন। নিজের জমি-জায়গা বলতে কিছুই নেই। ডিসি- ইউএনও যদি একটি সরকারি ঘরের ব্যবস্থা ও পাশাপাশি একটি কাজের ব্যবস্থা করে দেয় তাহলে চার শিশু সন্তানকে সে ভালো ভাবে চলতে পারবে।
জান্নাত বেগম বলেন, আমরা ভালোবেসে বিয়ে করি। আমাদের ঘরে চার শিশু সন্তান রয়েছে। আমার স্বামী মাঝেমধ্যে আসে। সন্তানদের খাবার দেয় না। এ অবস্থায় চার সন্তান নিয়ে কষ্ট হয়, বাড়ি ভাড়া কিভাবে দেব আর সন্তানদের মুখেই বা কিভাবে খাবার দেব। কষ্ট হচ্ছিল সংসার চালাতে। চার সন্তানকে নিয়ে কাজ করা সম্ভব না। আমার কেউ নাই এখানে। তাই বাধ্য হয়ে লোহার খাঁচা তৈরি করে রাস্তায় ঘুরে ঘুরে সাহায্য তুলে বেড়াচ্ছি। সারাদিন যা পাই তা দিয়েই দিন পার হয়ে যায়।
তিনি আরও বলেন, আমার মান-সম্মান যাক, বাচ্চা ৪টার জীবন তো বাঁচবে। আমি যদি এই পথ বেছে না নেই তাহলে আমরা বাচ্চাগুলো না খেয়ে মারা যাবে। আমি মেডিকেলেও গেছিলাম কিডনি বিক্রি করতে। তখন ডাক্তার বলেছে যদি কিডনি বিক্রি করে দেই তাহলে আমি দুর্বল হয়ে পড়ব। তাই আর বিক্রি করিনি। আবার আত্মহত্যা করতে গিয়ে মনে হলো, বাচ্চাদের কি হবে। শহরের অনেক লোক সন্তাদের কিনে নেওয়ার জন্য বিভিন্ন প্রস্তাবও দিয়েছিল, রাজী হয়নি। যতই কষ্ট হোক সন্তান কাউকে দেব না।
জান্নাত আরও বলেন, আমার কষ্টের কথা শুনে ডিসি স্যার কিছু খাবার পাঠিয়েছে। আবার অনেকেই বিভিন্নভাবে সাহায্যও করেছে। আমার ঘর-বাড়ি নাই। ডিসি ও ইউএনও স্যার যদি একটা ঘরের ব্যবস্থা করে দেয় তাহলে শিশু সন্তানদের নিতে শান্তি থাকতে পারতাম।
এ বিষয়ে জান্নাত বেগমের স্বামী হাবিল বলেন, আমি অভাবী মানুষ, জমি-জায়গায়, ঘর-বাড়ি কিছুই নাই। হাতের ওপর চলি। দেখা যায় বাচ্চার খাবার জোগাড় করলে নিজের খাবার জোটে না। আবার বাড়ি ভাড়া। এ নিয়ে আমাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ হয়। এগুলো সইতে না পেরে আমি বাড়ি থেকে চলে যাই। কয়েকদিন উপার্জন করে স্ত্রী-সন্তানকে টাকা পাঠাই। বাইরে থাকার কারণে আমার স্ত্রী মনে করে আমি পালায় গেছি। আমি খুব অসহায়, এ কারণে আমাদের স্বামী-স্ত্রীর দ্বন্দ্ব।
তিনি আরও বলেন, আমার আগের আরেকটা সংসার আছে। তাদের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নাই। তবে স্ত্রী সন্তান রেখে আর কোথাও যাব না। যতই কষ্ট হোক সন্তানদের মানুষ করব।
সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) খাইরুল ইসলাম বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখেছি এক নারী ৪ সন্তানকে একটি লোহার খাচায় করে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছেন। আমরা তার সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েছি। ডিসি স্যার এরই মধ্যে পরিবারটিকে খাবার দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। তার একটি মাথা গোঁজার ঠাঁই প্রয়োজন। আমরা দেখছি সরকারি কোনো ঘর ফাঁকা থাকলে তাকে দেওয়া হবে।
তিনি আরও বলেন, তার স্বামী হাবিল স্ত্রী ও বাচ্চাদের রেখে পালিয়ে যায়। আজ আবার এসেছে। আমরা তাকে বুঝিয়েছি। সে যেন একই ভুল বারবার না করে।
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)