সোমবার, ১৬ জুন ২০২৫, ২ আষাঢ় ১৪৩২


ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে চীন ও রাশিয়ার অবস্থান কী?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

প্রকাশিত:১৬ জুন ২০২৫, ১৭:২২

ছবি সংগৃহীত

ছবি সংগৃহীত

মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরানের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে পরিচিত চীন ও রাশিয়া। শুক্রবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠকে ইসরায়েলের অব্যাহত হামলার নিন্দা জানিয়েছে তারা। একইসঙ্গে অবিলম্বে চলমান উত্তেজনা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। এ সংঘাতের ভয়াবহ বৈশ্বিক পরিণতি হতে পারে বলেও সতর্ক করেছে।

সোমবার এক বিবৃতিতে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র গুও জিয়াকুন বলেন, ‘আমরা সব পক্ষকে আহ্বান জানাচ্ছি যেন তারা অবিলম্বে এমন পদক্ষেপ নেয় যা উত্তেজনা কমাবে, এই অঞ্চলকে আরো বিশৃঙ্খলার দিকে ঠেলে দেওয়া থেকে রক্ষা করবে। সেই আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানে যাওয়ার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করবে।’

গতকাল রোববার আরেক মুখপাত্র বলেন, ‘এই উত্তেজনা কমানোর প্রক্রিয়ায় চীন গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে আগ্রহী।’

এর আগে, গত ১৩ জুন চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের সাপ্তাহিক সংবাদ সম্মেলনে জানায়, তারা ইরানের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা ও ভূখণ্ডের অখণ্ডতা লঙ্ঘনের বিরোধিতা করে।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, যারা আঞ্চলিক উত্তেজনা বাড়ায় বা সংঘাত সৃষ্টি করে, চীন সেই ধরনের যেকোনো কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে। তারা চায়, সব পক্ষ যেন শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে কাজ করে এবং উত্তেজনা যেন আর না বাড়ে।

চীনের এক মুখপাত্রকে ওই সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করা হয়—যদি আবার ইরানের ওপর হামলা হয়, তবে হরমুজ প্রণালী বন্ধের ইরানি হুমকিকে কি চীন সমর্থন করবে?

তিনি সরাসরি জবাব দেননি, বরং বলেছেন—এ ধরনের অনুমানভিত্তিক প্রশ্নের উত্তর দেওয়া ঠিক নয় এবং এই অঞ্চলের পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে, সেটা কেউই চায় না।

ইসরায়েল ও ইরানে অবস্থিত চীনা দূতাবাসে হামলার পরে নিরাপত্তা সতর্কতা জারি করেছে এবং চীনা নাগরিকদের সতর্ক থাকতে বলেছে।

২০২৪ সালের অক্টোবর মাসেও চীন একই রকম অবস্থান নেয়।

তখনকার চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজকে বলেছিলেন, ‘অব্যাহত যুদ্ধ ও বিশৃঙ্খলা এ অঞ্চলের কোনো পক্ষের জন্যই ভালো নয়।’

তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, সব পক্ষ বুঝেশুনে কাজ করবে, যেন পরিস্থিতি খারাপের দিকে না যায়।

ওই একই মাসে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচির সঙ্গে বৈঠকে ওয়াং ই বলেন, চীন যেকোনো উত্তেজনা ও সংঘাতের বিরুদ্ধে এবং কোনো 'সামরিক কর্মকাণ্ড' সমর্থন করে না।

তিনি জানান, চীন শান্তির পক্ষে থেকে গঠনমূলক ভূমিকা রাখবে।

এছাড়াও, ২০২৪ সালের অক্টোবরেই জাতিসংঘে চীনের প্রতিনিধি ফু কং ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডের কড়া সমালোচনা করেন।

তিনি ইরানে ইসরায়েলের হামলা নিয়ে 'গভীর উদ্বেগ' প্রকাশ করেন এবং ইসরায়েলকে 'সব ধরনের উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড বন্ধ করার' আহ্বান জানান।

সবশেষে, ২০২৫ সালের ১২ জুন আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (IAEA) বোর্ড অব গভর্নরসের এক ভোটাভুটিতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং জার্মানির আনা একটি প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয় চীন ও রাশিয়া। ওই প্রস্তাবে ইরানকে তার পারমাণবিক প্রতিশ্রুতি ভাঙার অভিযোগ আনা হয়েছিল।

চীনের প্রতিনিধি লি সং বলেন, আন্তর্জাতিক সমাজ যেন ‘অবরোধ, চাপ ও শক্তির হুমকি’ ব্যবহার না করে।

তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তি থেকে সরে যাওয়াকে আজকের সমস্যার মূল কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন।

চীনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া

চীনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সিনা ওয়েইবোতে ইরান-ইসরায়েল সংঘর্ষ নিয়ে অনেক হ্যাশট্যাগ ট্রেন্ড করেছে। ইতোমধ্যে একটি সকাল ৮টা ৩৯ মিনিটে ট্রেন্ডিং সার্চ তালিকার শীর্ষে উঠে যায়, যেটি ১৬ কোটি বার দেখা হয়েছে এবং এতে ৭৬ হাজার মন্তব্য করা হয়।

চীনা রাষ্ট্রায়ত্ত টিভি চ্যানেল সিসিটিভি এই সংঘাতের নতুন ঘটনাগুলো সোজাসুজি ওয়েইবোতে সম্প্রচার করেছে।

ওয়েইবোতে একজন বিখ্যাত ভাষ্যকার হু শিজিন লিখেছেন, ‘ইরান এখন ঝাঁঝার মতো ছিদ্রযুক্ত হয়ে গেছে। কারণ, মোসাদ বিপ্লবী গার্ডসের কমান্ডার-ইন-চিফ মেজর জেনারেল হোসেইন সালামি এবং অন্তত দুইজন পারমাণবিক বিজ্ঞানীর সঠিক অবস্থান নির্ভুলভাবে শনাক্ত করে এবং ইসরায়েলি বাহিনী তাদের হত্যা করে।’

এই কর্মকাণ্ডকে ‘সন্ত্রাসী হামলা’ বলেছেন তিনি।

আরেক ভাষ্যকার শেন ই ইরানের অভ্যন্তরে ‘অনুপ্রবেশ’ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি জানতে চান, সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী মহলের কেউ কি ‘ইসরায়েলের সঙ্গে পদ্ধতিগতভাবে আঁতাত করেছে এবং বিদেশি শক্তিকে ব্যবহার করে অভ্যন্তরীণ অভিযান চালাচ্ছে?’

অন্য একটি পোস্টে হু শিজিন ইরানের কঠোর ভাষা অথচ বাস্তবে প্রতিরোধহীন অবস্থাকে ‘একটি ট্র্যাজেডি’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এটি চীনের জন্য একটি শিক্ষা বলেও মনে করেছেন যে, ‘ক্ষমতাই একমাত্র নির্ধারক উপাদান এবং যে অবস্থানের পেছনে শক্তি নেই, সেটিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দরকষাকষির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যায় না।’

জিভো শিয়াশি নামে একজন জাতীয়তাবাদী ব্লগার বলেছেন, ইসরায়েলের কর্মকাণ্ড প্রমাণ করে যে ‘তুমি যদি হাঁটু গেড়েও বসো, তবু প্রতিপক্ষ তোমাকে ক্ষমা নাও করতে পারে।’

তিনি লেখেন, ‘সত্য কেবল লোহার মুষ্টির নিচে থাকে। তুমি যদি জেতো, তাহলে তুমিই ঠিক। এটাই হলো এই জঙ্গলসদৃশ পৃথিবীতে টিকে থাকার নিয়ম।’

রাজনৈতিক ভাষ্যকার লি শাওসিয়ান সিসিটিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সম্প্রতি ট্রাম্প ও ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর মধ্যে হওয়া ফোনালাপে ট্রাম্পের অবস্থান ‘বাস্তবিক অর্থে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার জন্য ইসরায়েলকে সবুজ সংকেত দেওয়ার’ মতো ছিল।

ইরানকে কীভাবে সহায়তা করতে পারে রাশিয়া

ইসরায়েলের ইরান হামলা নিয়ে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনগুলো খুব বেশি প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত দুটি প্রধান চ্যানেল-রাশিয়া চ্যানেল ১ এবং চ্যানেল ওয়ান রিপোর্ট করেছে যে ইসরায়েল শুধু পারমাণবিক স্থাপনাগুলো নয়, বেসামরিক এলাকাও লক্ষ্যবস্তু করেছে।

রাশিয়া চ্যানেল ১ জানিয়েছে যে, এই প্রথমবারের মতো আবাসিক এলাকায় হামলা চালানো হয়েছে। তবে দুটি চ্যানেলই জোর দিয়ে বলেছে, এসব এলাকায় ইরানের ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তারা অবস্থান করায় এগুলো টার্গেট করা হয়।

তবে এতে বেসামরিক লোকজনও নিহত হয়েছে।

টেলিগ্রামে ‘জাপিসকি ভেটেরান’ নামের একটি চ্যানেল ধ্বংস হওয়া ভবন ও গাড়ির ছবি প্রকাশ করে ব্যঙ্গ করে লিখেছে, ‘এইসবই সম্ভবত সেই পারমাণবিক সামরিক স্থাপনা, যার কথা ইসরায়েল বলছিল। এখন দেখা যাক, তথাকথিত সভ্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আজ কী প্রতিক্রিয়া দেখায়।’

ইউরি পডোলিয়াকা নামের একজন লেখেন, তিনি অপেক্ষা করছেন ‘ইউরোপীয় গ্লোবাল গণতান্ত্রিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে এরকম সংঘাত সমাধানের পদ্ধতি সম্পর্কে কোনো বিবৃতি আসে কি না।’

তিনি যোগ করেন, ‘আমার মনে হয়, কিছুই বলা হবে না।’

আরও কিছু ভাষ্যকার ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের রাশিয়ার ওপর সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে মন্তব্য করেন।

সার্গেই মার্কভ, প্রো-ক্রেমলিন ভাষ্যকার ও রাশিয়ার সাবেক সংসদ সদস্য, বলেন, যদিও রাশিয়া সম্প্রতি ইরানের সঙ্গে একটি বিস্তৃত কৌশলগত অংশীদারিত্ব চুক্তিতে সই করেছে, তবে তিনি মনে করেন না যে রাশিয়া এই সংঘাতে জড়াবে।

মার্কভ তার টেলিগ্রাম চ্যানেলে লেখেন, ‘রাশিয়া ইরানের বন্ধু এবং রাজনৈতিক মিত্র, কিন্তু সামরিক মিত্র নয়।’

তিনি আরও যোগ করেন, রাশিয়ার একমাত্র সম্ভাব্য ভূমিকা হতে পারে একটি ‘রাজনৈতিক সমাধানে মধ্যস্থতা করা। তবে সেটা পরে হবে। এখন রাশিয়া ও অন্য সব দেশ সামরিক-মিসাইল পর্যায় পর্যবেক্ষণ করবে।’

রাশিয়ার চ্যানেল ওয়ানের উপস্থাপক আরতিয়ম শেইনিনও টেলিগ্রামে একমত পোষণ করে বলেন, ‘সবকিছুই খুব অনিশ্চিত। সম্প্রতি, ইউক্রেন থেকে মধ্যপ্রাচ্যে হাজার হাজার বিমান প্রতিরক্ষা শেল সরিয়ে নেওয়ার খবর ইঙ্গিত দেয় যে যুক্তরাষ্ট্র হয়তো দ্বিমুখী খেলা খেলছে।’

এদিকে, রাশিয়ান ফেডারেশন এবং ইসলামিক রিপাবলিক অব ইরানের মধ্যে গত ১৭ জানুয়ারি স্বাক্ষরিত বিস্তৃত কৌশলগত অংশীদারিত্ব চুক্তিতে ‘সামরিক সহযোগিতার উন্নয়ন’ অন্তর্ভুক্ত আছে। তবে এপ্রিল মাসে রাশিয়ার উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রেই রুডেনকো বলেন, ‘যদি ইরান যুদ্ধে জড়ায়, তবুও রাশিয়া সামরিক সহায়তা দিতে বাধ্য নয়।’

সম্পর্কিত বিষয়:

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)
আরো পড়ুন

সর্বশেষ

জনপ্রিয়

নামাজের সময়সূচি

ওয়াক্ত সময়সূচি
ফজর ০৩:৪৪ ভোর
যোহর ১১:৫৯ দুপুর
আছর ০৪:৩৯ বিকেল
মাগরিব ০৬:৫১ সন্ধ্যা
এশা ০৮:১৫ রাত

সোমবার ১৬ জুন ২০২৫