বুধবার, ৩০ জুলাই ২০২৫, ১৪ শ্রাবণ ১৪৩২
ছবি সংগৃহীত
জান্নাত একজন মুমিনের চূড়ান্ত পুরস্কার। কোরআন ও সহিহ হাদিসে জান্নাতে প্রবেশের বহু মাধ্যম ও উপায় বর্ণিত হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো ইলম বা জ্ঞান অন্বেষণ। প্রিয়নবী (স.) এই শ্রেণির মানুষকে চিহ্নিত করেছেন, যাদের জন্য আল্লাহ জান্নাতের পথ সহজ করে দেন।
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন- مَنْ سَلَكَ طَرِيقًا يَلْتَمِسُ فِيهِ عِلْمًا سَهَّلَ اللَّهُ لَهُ بِهِ طَرِيقًا إِلَى الْجَنَّةِ ‘যে ব্যক্তি জ্ঞান অন্বেষণের জন্য কোনো পথ অবলম্বন করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের পথ সহজ করে দেন।’ (সহিহ মুসলিম: ২৬৯৯)
এই হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) জানিয়ে দিয়েছেন যে, যারা ইলম বা জ্ঞানের পথে আগ্রহী, যারা দ্বীন শিখতে চায়, তারা শুধু জ্ঞানের জন্যই নয়, বরং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে এ পথে এগোয়, আল্লাহ তাদের জান্নাতে যাওয়ার পথ সহজ করে দেন। এই ‘পথ’ শুধু শারীরিক চলাচলের জন্য নয় বরং এটি জ্ঞানার্জনের জন্য মানসিক প্রস্তুতি, সময় ব্যয়, কষ্ট সহ্য করা, এমনকি দ্বীনি বই পড়া বা কোনো আলেমের কাছে যাওয়া—সবকিছুই অন্তর্ভুক্ত।
ইলম অন্বেষণকারীর মর্যাদা
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আল্লাহ তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদের জ্ঞান দান করা হয়েছে তাদের মর্যাদা উন্নীত করবেন।’ (সুরা মুজাদালাহ: ১১) আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘বলুন, যারা জানে এবং যারা জানে না, তারা কি সমান? বোধশক্তি সম্পন্ন লোকেরাই শুধু উপদেশ গ্রহণ করে।’ (সুরা জুমার: ৯)
রাসুল (স.) বলেন, ‘বিশ্বের সমস্ত কিছু জ্ঞান অন্বেষণকারীর জন্য দোয়া করে, এমনকি মাছ এবং পাখিও।’ (তিরমিজি: ২৬৮২) নবীজি আরও বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা যার কল্যাণ চান তাকে দ্বীনের বিশুদ্ধ বুঝ দান করেন।’ (সহিহ বুখারি: ৭১; সহিহ মুসলিম: ১০৩৭)
কোন ধরনের জ্ঞানে এই ফজিলত?
সকল প্রকার জ্ঞান সমান মর্যাদার নয়। জ্ঞানের প্রকার অনুযায়ী ফজিলতও ভিন্ন। জান্নাত সহজ হওয়ার জন্য যে জ্ঞান অর্জনের কথা এখানে বলা হচ্ছে, তা নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
১. ফরজে আইন (ব্যক্তিগত আবশ্যকীয় জ্ঞান): তাওহিদ (আল্লাহর একত্ববাদ), নামাজ, রোজা ইত্যাদি ইবাদতের বিধান, অজু গোসলের বিধান, হালাল-হারামের মৌলিক বিধান, ব্যবসায়ীদের ক্রয়-বিক্রয়ের বিধি-বিধান, পেশাজীবীদের জন্য প্রয়োজনীয় দ্বীনি বিধান, কোরআনের বিশুদ্ধ তেলাওয়াত (অন্তত নামাজে যতটুকু পড়া হয়)। প্রত্যেক মুসলিমের জন্য এ জ্ঞান অর্জন ফরজ। রাসুল (স.) বলেছেন, ‘জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরজ।’ (সুনান ইবনে মাজাহ: ২২৪) এ জ্ঞান ছাড়া ঈমান ও আমল সঠিক হওয়া সম্ভব নয়, তাই এর সওয়াব সর্বোচ্চ।
২. ফরজে কেফায়া (সমষ্টিগত আবশ্যকীয় জ্ঞান): ইসলামিক আইন (ফিকহ), আরবি ভাষা ও তাফসির শাস্ত্র, হাদিসের গভীর অধ্যয়ন। সমাজের কিছু লোক এ জ্ঞান অর্জন করলে অন্যরা দায়মুক্ত হয়ে যায়। এ জ্ঞান সমাজের কল্যাণে ব্যবহৃত হয় বলে তা সওয়াবের কাজ।
৩. উপকারী দুনিয়াবি জ্ঞান: চিকিৎসা বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও প্রযুক্তি, কৃষি ও অর্থনীতি। যদি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ও মানবকল্যাণে ব্যবহৃত হয়, তবে তা ইবাদত হিসেবে গণ্য। (সহিহ বুখারি: ০১; সহিহ মুসলিম: ১৬৩১)
জ্ঞান অর্জনের সঠিক পদ্ধতি
ইসলামি জ্ঞানার্জনের নিরাপদ পদ্ধতি হলো কোনো প্রাজ্ঞ আলেমের সান্নিধ্যে থেকে শেখা, যাতে জটিল বিষয় পরিষ্কার হয় ও বিভ্রান্তি দূর হয়। যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলে আলেমদের কাছে প্রশ্ন করে জ্ঞান নিতে হবে। তাও সম্ভব না হলে নির্ভরযোগ্য বই-পুস্তক পড়ে শেখা যেতে পারে। আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহ.) বলেন, ইলম ছাড়া কিছুই সম্ভব নয়, আর তা জিজ্ঞাসা ছাড়া অর্জন করা যায় না। ইমাম গাজালি (রহ.) বলেন, যে বিষয়ে জ্ঞান না থাকলে ভুল হতে পারে, তা শেখা প্রতিটি মানুষের জন্য জরুরি। (জামিউ বায়ানিল ইলম: ১/৫৬; ইহয়াউ উলুমিদ্দিন: ১/৩৪)
সতর্কতা
যেকোনো জ্ঞানই তখনই ফজিলত বয়ে আনে, যখন
১. নিয়ত হবে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য।
২. জ্ঞান দ্বারা ইসলাম ও মানবতার সেবা করা হবে।
৩. অহংকার বা বিতর্ক থেকে দূরে থাকা হবে।
৪. জাল সনদ বা জাল বর্ণনার ব্যাপারে সতর্ক থাকা হবে।
(বুখারি ০১; আবু দাউদ: ৩৬৬৪; বুখারি: ১১০)
জ্ঞানার্জনের এই পবিত্র যাত্রায় আমাদের সকলের অংশগ্রহণ কামনা করে শেষ করছি রাসুল (স.)-এর এই দোয়া দিয়ে- اللَّهُمَّ انْفَعْنِي بِمَا عَلَّمْتَنِي وَعَلِّمْنِي مَا يَنْفَعُنِي ‘হে আল্লাহ! আমাকে যা শিখিয়েছেন তা দ্বারা উপকৃত করুন এবং আমাকে এমন জ্ঞান দান করুন যা আমার জন্য উপকারী।’ (তিরমিজি: ৩৫৯৯; ইবনে মাজাহ: ২৫১; আবি শায়বা: ১০/২৮১)
ডিএস /সীমা
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)