রবিবার, ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২৩ ভাদ্র ১৪৩২


হুদায়বিয়ার সন্ধি: যে বেদনাদায়ক ২ শর্তে লুকিয়েছিল নবীজির প্রজ্ঞা

ধর্ম ডেস্ক

প্রকাশিত:৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৬:৪৪

ছবি ‍সংগৃহিত

ছবি ‍সংগৃহিত

মহানবী হজরত মুহাম্মদ (স.)–এর জীবনে হুদায়বিয়ার সন্ধি একটি ঐতিহাসিক মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা। হিজরির ষষ্ঠ সনে মুসলমানদের সঙ্গে মক্কার কোরাইশদের এ সন্ধি সম্পাদিত হয়। বাহ্যিকভাবে এর শর্তগুলো মুসলমানদের কাছে অপমানজনক মনে হয়েছিল। বিশেষত দুটি শর্ত সাহাবিদের মধ্যে হতাশা ও শঙ্কার জন্ম দিয়েছিল। বাস্তবে তা ছিল নবীজির মহা দূরদর্শিতার অংশ।

দুটি বেদনাদায়ক শর্ত
১. রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছিলেন, তিনি আল্লাহর ঘরে গমন করবেন এবং কাবা শরিফ তাওয়াফ করবেন। কিন্তু চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, সে বছর মুসলমানরা ওমরা আদায় না করেই মদিনায় ফিরে যাওয়ার সম্মতি দেন। এটি সাহাবিদের কাছে দুঃখজনক মনে হয়েছিল।

কিন্তু বাস্তবে এই শর্তে পরের বছর নিরাপদে ওমরা করার গ্যারান্টি ছিল, যেই নিশ্চয়তা ছিল না সন্ধি ছাড়া। মূলত এই চুক্তির মাধ্যমে রাসুল (স.)-এর স্বপ্ন স্বার্থক হবার সুযোগ সৃষ্টি হয়।

২. কেউ পালিয়ে গিয়ে মুসলিম পক্ষে যোগ দিলে তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে কিন্তু কোরাইশদের কাছে কেউ গেলে তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে না। এটাও মুসলমানদের কাছে ক্ষতিকর মনে হয়েছিল।

কিন্তু বাস্তবে এই শর্তও কোরাইশদের জন্য উপকারী ছিল না। তারই প্রমাণ পাওয়া যায় আবু জান্দাল, আবু বাছির, সুহায়েল বিন আমর প্রমুখের ঘটনায়। তাদের ঈমানি জাজবাকে এই চুক্তি দিয়ে আটকে রাখা যায়নি। তারা সিরিয়ার নিকটবর্তী সমুদ্রোপকূলে ঈছ (العِيْص) পাহাড়ি এলাকায় গিয়ে অন্যান্য মুসলমানদের নিয়ে দল গঠন করে এবং কোরায়েশদের বাণিজ্য কাফেলার জন্য কঠিন হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। এক বছরের মধ্যে সেখানে প্রায় তিনশ মুসলমান জমা হয়ে যায়। ফলে এই ধারাটি অবশেষে কোরাইশদের বিপক্ষে চলে যায় এবং তারা মদিনায় গিয়ে উক্ত ধারা বাতিলের আবেদন জানায়। (সিরাহ সহিহাহ: ২/৪৫১)

সাহাবিদের হতাশা
নবীজি ছিলেন আল্লাহর রাসুল এবং সত্যের প্রতীক। আল্লাহ তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করবেন বলে তিনি ঘোষণা করেছিলেন। অথচ কোরাইশদের চাপে পড়ে একতরফা ও অপমানজনক মনে হওয়া চুক্তির শর্ত মেনে নেওয়ায় অনেক সাহাবি বিভ্রান্ত ও হতাশ হয়ে পড়েন। বিশেষ করে হজরত ওমর (রা.) এ ব্যাপারে প্রবল বেদনা অনুভব করেন।

হজরত ওমর (রা.) প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আমরা কি সত্যের উপর নই এবং তারা কি মিথ্যার উপর নয়?’ উত্তরে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘অবশ্যই।’ ওমর (রা.) আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘তাহলে কেন আমরা আল্লাহর দ্বীন সম্পর্কে মুশরিকদের চাপের কাছে নতি স্বীকার করছি?’ নবীজি শান্তভাবে উত্তর দেন, ‘হে খাত্তাবের সন্তান! আমি আল্লাহর রাসুল, তাঁর অবাধ্য নই। তিনি-ই আমার সাহায্যকারী, আমাকে কখনো ধ্বংস হতে দেবেন না।’

পরে আল্লাহ তাআলা সুরা ফাতহ অবতীর্ণ করেন— اِنَّا فَتَحۡنَا لَکَ فَتۡحًا مُّبِیۡنًا ‘নিশ্চয় আমি আপনাকে দিয়েছি সুস্পষ্ট বিজয়।’ (৪৮:১)

এ আয়াত নাজিল হওয়ার পর সাহাবিরা আশ্বস্ত হন এবং বুঝতে পারেন—বাহ্যত কঠিন মনে হলেও এর ভেতর নিহিত রয়েছে বিজয়ের ইশারা, যাকে স্বয়ং আল্লাহ তাআলা ‘ফাতহুম মুবিন’ বা ‘সুস্পষ্ট বিজয়’ বলে অভিহিত করছেন।

সন্ধিটি বাস্তবে বিজয়ের রাস্তা ছিল
চুক্তির ফলে মুসলমানরা প্রথমবারের মতো স্বস্তি ও নিরাপত্তা লাভ করেন। যুদ্ধের হুমকি প্রশমিত হয় এবং ইসলাম প্রচারের পথ খুলে যায়। এ সময় নবীজি (স.) বিশ্বের বিভিন্ন শাসকের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেন। খালিদ ইবনে ওয়ালিদ, আমর ইবনে আস প্রমুখ প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব ইসলাম গ্রহণ করেন। মুসলমানদের শক্তি বহুগুণে বৃদ্ধি পায়।

ঐতিহাসিক পি. কে. হিট্টি যথার্থই বলেছেন- ‘মুহাম্মদ (স.) মাত্র ১৪০০ সাহাবি নিয়ে হুদায়বিয়ায় গিয়েছিলেন, কিন্তু দুই বছর পর মক্কা বিজয়ের সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন ১০ হাজার।’

কোরআনের দৃষ্টিতে ‘সুস্পষ্ট বিজয়’
আল্লাহ তাআলা সুরা ফাতহ-এ এই সন্ধিকে ‘সুস্পষ্ট বিজয়’ (ফাতহুম মুবিন) ঘোষণা করেছেন। কারণ এর মধ্যে নিহিত ছিল বহুমুখী সাফল্য, যার মধ্যে রয়েছে:

নৈতিক ও আত্মিক বিজয়: হুদায়বিয়ার সন্ধি মুসলমানদের জন্য শান্তি ও সম্মানের সুযোগ এনে দিয়েছিল। এটি মক্কার মুশরিকদের নৈতিক কর্তৃত্বকে ভেঙে দেয় এবং মুসলিমদের একটি স্বতন্ত্র মর্যাদা প্রদান করে।

ভূ-রাজনৈতিক সুবিধা: এই চুক্তি মদিনার মুসলিম রাষ্ট্রকে একটি বৈধ সত্তা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, যা তাদেরকে অন্যান্য শক্তির সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে এবং নিজেদের অবস্থানকে সুসংহত করতে সাহায্য করে।

ভবিষ্যৎ বিজয়ের ভিত্তি: এই শান্তির পরিবেশ মুসলমানদের নির্বিঘ্নে দাওয়াত ও প্রচারের সুযোগ করে দেয়, যার ফলে ইসলাম গ্রহণকারীদের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। হুদায়বিয়ার পর এই শক্তিশালী বাহিনীই মাত্র দুই বছর পর মক্কা বিজয় সম্পন্ন করে।

ঐশী প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন: এই আয়াতটি ছিল নবীজি (স.) এবং তাঁর সাহাবিদের ধৈর্য ও বিশ্বাসের প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে এক নিশ্চিত বার্তা, যা তাঁদেরকে আশ্বস্ত করেছিল যে আল্লাহ তাঁদের সঙ্গেই আছেন, যদিও পরিস্থিতি তখন প্রতিকূল মনে হচ্ছিল।

অতএব, ‘সুস্পষ্ট বিজয়’ একটি ব্যাপক ধারণা, যা তাৎক্ষণিক কৌশলগত সুবিধা এবং ভবিষ্যতে ইসলামের মহাবিজয়ের বীজ উভয়কেই ধারণ করে।

মোটকথা, যে দুটি শর্ত প্রথমে মুসলমানদের হৃদয়ে গভীর বেদনার সৃষ্টি করেছিল, পরবর্তীকালে সেগুলোই ইসলামের প্রসার ও মুসলমানদের শক্তি বৃদ্ধির দ্বার উন্মুক্ত করে। হুদায়বিয়ার সন্ধি প্রমাণ করে- আল্লাহর রাসুলের (স.) দূরদর্শী নেতৃত্বের পেছনে লুকিয়ে থাকে আল্লাহর পরিকল্পনা, যা শেষ পর্যন্ত মুসলমানদের জন্য কল্যাণকর হয়।

(সহিহ বুখারি; সহিহ মুসলিম; ফাতহুল বারি; ইবন হিশাম, জাদুল মাআদ)

সম্পর্কিত বিষয়:

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)
আরো পড়ুন

সর্বশেষ

জনপ্রিয়

নামাজের সময়সূচি

ওয়াক্ত সময়সূচি
ফজর ০৪:২৫ ভোর
যোহর ১২:৫৭ দুপুর
আছর ০৪:২৫ বিকেল
মাগরিব ০৬.১৪ সন্ধ্যা
এশা ০৭:২৮ রাত

রবিবার ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫