শনিবার, ২৬ জুলাই ২০২৫, ১১ শ্রাবণ ১৪৩২
ছবি সংগৃহীত
পৃথিবীর সবচেয়ে নিচু ভূ-অবস্থান এবং অতিরিক্ত লবণাক্ততার জন্য পরিচিত ডেড সি বা মৃত সাগর এক বিস্ময়কর প্রাকৃতিক গবেষণাগার হয়ে উঠেছে বিজ্ঞানীদের কাছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই হ্রদের গভীরে জমে ওঠা বিশাল লবণের স্তর এবং পাহাড় সৃষ্টির পেছনের জটিল প্রক্রিয়া নিয়ে নতুন ধারণা পেয়েছেন গবেষকরা।
‘ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, সান্তা বারবারা’র অধ্যাপক একার্ট মাইবুর্গের নেতৃত্বে পরিচালিত একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় জানা গেছে, ডেড সি’র গভীরে কিলোমিটারের পর কিলোমিটার বিস্তৃত লবণের স্তর তৈরি হচ্ছে, যার পুরুত্ব এক কিলোমিটার বা তারও বেশি। সাধারণত এমন স্তরগুলো ভূমধ্যসাগর বা লোহিত সাগরের গভীরে লুকিয়ে থাকে, কিন্তু ডেড সি হলো বিরল একটি স্থান যেখানে লবণের পাহাড় গঠনের প্রক্রিয়া চোখের সামনে দেখা সম্ভব।
ডেড সি একটি টার্মিনাল হ্রদ, অর্থাৎ এর কোনো বহির্গমন পথ নেই। ফলে এখানে প্রবাহিত পানি কেবল বাষ্প হয়ে উড়ে যায়, কিন্তু লবণ থেকে যায়। হাজার হাজার বছর ধরে এই বাষ্পীভবনের প্রক্রিয়ায় গভীরে জমে উঠেছে মোটা লবণের স্তর।
সাম্প্রতিক সময়ে মানুষের হস্তক্ষেপ—বিশেষ করে জর্দান নদীর ওপর বাঁধ নির্মাণ—ডেড সি’র পানিপ্রবাহ কমিয়ে দিয়েছে। ফলে পানি কমে যাওয়ার হার প্রতি বছর প্রায় এক মিটার, যা লবণ জমার প্রক্রিয়া আরও ত্বরান্বিত করেছে।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তাপমাত্রার পরিবর্তন। একসময় ডেড সি ছিল ‘মেরোমিকটিক’—যেখানে উপরের গরম ও কম লবণাক্ত পানি এবং নিচের ঠান্ডা ও বেশি লবণাক্ত পানি আলাদা স্তরে অবস্থান করত। কিন্তু ১৯৮০-এর দশক থেকে মিষ্টি পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় লবণাক্ততা বেড়ে যায়, স্তরগুলো একসঙ্গে মিশে গিয়ে এটি হয়ে পড়ে ‘হোলোমিকটিক’ হ্রদ—অর্থাৎ প্রতি বছর অন্তত একবার পুরো হ্রদের পানি মিশে যায়।
এই মিশ্রণের পর গরম মৌসুমে হ্রদের পানিতে আবার স্তরবিন্যাস তৈরি হয়। এ সময় ঘটে এক অদ্ভুত ঘটনা—‘লবণের তুষারপাত’। ২০১৯ সালে অধ্যাপক মাইবুর্গের গবেষণা দল আবিষ্কার করে, পানির উপরের স্তরে গঠিত লবণের স্ফটিক—‘হ্যালাইট’—ধীরে ধীরে পানির নিচে ঝরে পড়ে, যেন পানির নিচেই হচ্ছে এক ধরনের তুষারপাত।
এর কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা ব্যাখ্যা দিয়েছেন ‘ডবল ডিফিউশন’ নামে পরিচিত একটি প্রক্রিয়া। গরম ও অত্যন্ত লবণাক্ত পানি ঠান্ডা হয়ে নিচে নামে, আর তুলনামূলকভাবে ঠান্ডা পানি ওপরে উঠে গরম হয়। যখন এই ঠান্ডা স্তর আবার শীতল হয়, তখন অতিরিক্ত লবণ স্ফটিক আকারে নিচে জমা হতে থাকে।
এই চলমান প্রক্রিয়া—বাষ্পীভবন, পানির স্তরবিন্যাস এবং ঋতুবদলের সম্মিলিত প্রভাব—ধীরে ধীরে ডেড সি’র তলদেশে লবণের পাহাড় ও স্তর গঠনে ভূমিকা রাখে। এসব গঠন শুধু চিত্তাকর্ষক নয় বরং প্রাচীন ভূতাত্ত্বিক ঘটনাও ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করে।
উদাহরণস্বরূপ, কোটি কোটি বছর আগে ভূমধ্যসাগর একসময় প্রায় সম্পূর্ণ শুকিয়ে গিয়েছিল—যা ‘মেসিনিয়ান স্যালিনিটি ক্রাইসিস’ নামে পরিচিত। তখনো একইভাবে বিশাল লবণের স্তর গঠিত হয়েছিল। পরবর্তীকালে জিব্রাল্টার প্রণালী খুলে গেলে সেই অঞ্চল আবার পানিতে ভরে যায়।
ডেড সি’র গভীরে লবণের ঝর্ণা, স্তর, গম্বুজ ও চিমনির মতো গঠন এ সব প্রক্রিয়ারই ফল। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, এসব গবেষণা কেবল অতীতের ভূপৃষ্ঠ গঠন বোঝাতেই নয় বরং ভবিষ্যতের কিছু বড় চ্যালেঞ্জ—যেমন শুষ্ক অঞ্চলে উপকূল ক্ষয়, পানি সংকট এবং পরিবেশবান্ধব লবণ আহরণ—এসব বিষয়ে নতুন পথ দেখাতে পারে।
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)