মঙ্গলবার, ৫ আগস্ট ২০২৫, ২১ শ্রাবণ ১৪৩২


মাতুয়াইল যেন এক টুকরো ‘পুরান’ ঢাকা (পর্ব-২)

এলাকাজুড়ে সারি সারি বৈধ-অবৈধ ভবন!

জেহাদ হোসেন চৌধুরী

প্রকাশিত:৫ আগষ্ট ২০২৫, ০৮:০৭

ছবি- দৈনিক সময়

ছবি- দৈনিক সময়

২০১৭ সালে তৎকালীন ‘ইউনিয়ন পরিষদ’ বিলুপ্ত করে মাতুয়াইল এলাকাকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ৬টি ওয়ার্ডের (৬৫ থেকে ৭০) সমন্বয়ে গঠিত মাতুয়াইল পরবর্তিতে রাজউক জোন-৬ এর আওতাভুক্ত হয়। এরপর মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে খুব দ্রুতই রাজধানীর অন্যতম ঘনবসতি এলাকার তালিকায় যুক্ত হতে চলেছে মাতুয়াইল। দৃষ্টি সীমানায় মাতুয়াইলের চারিদিকে এখন নির্মাণাধীন বৈধ-অবৈধ, আবাসিক/বাণিজ্যিক বহুতল ভবনের সারি। ব্যক্তি মালিকানা কিংবা ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান; যে যেভাবে পারছে তাদের মনের মাধুরী মিশিয়ে অপরিকল্পিতভাবে, গাদাগাদি করে একটার গা ঘেষে আরেকটা ভবন নির্মাণের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। যেন কেউ কিছুই দেখছে না, কোথাও কারো কোন জবাবদিহিতা নেই! এখন হঠাৎ দেখে কেউ বুঝতেই পারবে না- ‘মাত্র বছর কয়েক আগেও বর্ষা মৌসুমে মাতুয়াইলের ৮০ ভাগেরও বেশি জায়গা গলা পানিতে তলিয়ে থাকতো। এখন যে কারোরই মনে হবে- এতো মাতুয়াইল নয়! যেন এক টুকরো ‘পুরান’ ঢাকা।

সূত্র মতে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশ ঘেষা মাতুয়াইলে বর্তমানে ফাঁকা জায়গা নেই বললেই চলে। আধুনিক নির্মাণের ছোঁয়া লেগেছে পুরো এলাকাটিতে। প্রকাশ্যে কিংবা আড়ালে কমপক্ষে ৩০টির অধিক ডেভেলপার কোম্পানী তাদের ব্যবসা পরিচালনা করছে মাতুয়াইলজুড়ে। এছাড়া একক কিংবা সমষ্টিগতভাবেও নির্মিত ভবনের সংখ্যা আছে শত শত। নির্মাণাধীন এসব ভবনের কোনটা রাজউক অনুমোদিত আবার কোনটা অনুমোদনহীন। কোনটা হাঁটু পানিতে। কোনটা চিপাগলিতে, মাঝ বিলেও একাধিক বহুতল ভবনের ছড়াছড়ি। এলাকাটিতে রাজউকের অনুমোদন নিয়েও নকশার ব্যত্যয় করেছে- এমন ভবনের সংখ্যা ভুরিভুরি। দেশের নির্দিষ্ট কয়েকটি জেলা- চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, কুমিল্লা, সিলেট, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের লোকজনের আধিক্য বেশি এখানে। বিভিন্ন ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান ছাড়াও উল্লেখিত অঞ্চলের অনেক ব্যবসায়ি, চাকরিজীবী একত্রিত হয়ে মাতুয়াইলে বসতি গড়ছেন।

মাতুয়াইল এলাকার বেশ কয়েকটি ওয়ার্ডে দীর্ঘ একমাসেরও অধিক সময় নিয়ে করা অনুসন্ধানে জানা গেছে, এলাকায় নির্মাণাধীন অধিকাংশ ভবনই অপরিকল্পিত এবং অনিয়মে ভরপুর। অধিকাংশ ভবনের মালিক কিংবা নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান রাজউকের নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে ভবন নির্মাণ করেছে, কিংবা করছে। পুরো এলাকাজুড়েই সারি সারি ভবন। ফাঁকা জায়গা নেই বললেই চলে। ন্যূনতম ৬ তলা থেকে শুরু করে ১০/১২/১৫ কিংবা তারও অধিক উচ্চতাসম্পন্ন বহুতল ভবন অনিয়ন্ত্রিতভাবে একটার গা ঘেষে আরেকটা ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। নির্মাণাধীন এসব ভবনের কোনটা রাজউক অনুমোদিত আবার কোনটা অনুমোদনহীন। কোনটা হাঁটু পানিতে, কোনটা চিপাগলিতে। মাঝ বিলেও একাধিক বহুতল ভবনের ছড়াছড়ি। এলাকাটিতে রাজউকের অনুমোদন নিয়েও নকশার ব্যত্যয় করেছে- এমন ভবনের সংখ্যা ভুরিভুরি।

ভবন মালিকদের কেউ কেউ ৬ তলার অনুমোদনে ৮ তলা করেছে, আবার কেউ ১০ কে বানিয়েছে ১২। কেউ আবাসিকের অনুমোদনে করেছে বাণিজ্যিক, আবার কেউ গ্যারেজের জায়গায় করেছে ফ্ল্যাট। কেউ আবার ছাদ বাড়িয়ে ‘রুফটপ’ রেষ্টুরেন্ট করে দিব্যি ভাড়া খাচ্ছে। কেউ আবার কোনপ্রকার নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করেই একটার পর একটা ভবন হাঁকিয়ে চলেছে। আর এসব ভবনের ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্র ও নকশা অনুমোদন দিয়েছে রাজউক। নিয়মিত তদারকিও করেছে ইমারত পরিদর্শক থেকে শুরু করে রাজউকের সংশ্লিষ্ট জোনের (যে যখন দায়িত্বে ছিলেন) অথরাইজড অফিসাররা। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে- তাহলে কেন এবং কীভাবে মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে মাতুয়াইল এলাকা এতোটা অনিয়ন্ত্রিত এবং অপরিকল্পিত ভবনে পরিপূর্ণ হলো?

এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে মাতুয়াইল এলাকায় দীর্ঘবছর ধরে ব্যবসা করা ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানের একজন নির্বাহী দৈনিক সময়কে বলেন, ‘গত সাত বছর যাবত মাতুয়াইলের বিভিন্ন এলাকায় ল্যান্ড ডেভেলপমেন্টের কাজ করছে তার কোম্পানি। দৃশ্যমান কোন রাস্তা ছাড়াই হাঁটু কিংবা গলাপানিতে, বিলের মাঝখানে কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে ৮/১০ ফুট চিপা রাস্তার পাশে রাজউক থেকে ১০/১২ তলা ভবনের নকশা অনুমোদন নিয়েও অধিকাংশ ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে কম-বেশি ডেভিয়েশন করেছে তার কোম্পানি।’

তিনি আরও জানান, “কোনভাবে একটু এদিক-সেদিক করে একটি/দুটি ফ্লোর বাড়াতে পারলেই কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য। কোন ল্যান্ড ব্যবসায়িই সুযোগ পেলে এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চান না। আর যত ঝামেলাপূর্ণ জায়গাই হোক না কেন- রাস্তা থাকুক বা না থাকুক, শুরুতেই সার্ভেয়ার-ইন্সপেক্টর-অথরাইজড অফিসার ম্যানেজ করতে পারলে রাজউকের ছাড়পত্র আর নকশা অনুমোদন পাওয়া কোন ব্যাপারই না।’ মাতুয়াইল তথা পুরো ঢাকা শহরে ৯০ ভাগের বেশি ভবনে ডেভিয়েশন আছে এবং প্রত্যেকেই নিয়মিতভাবে রাজউককে ম্যানেজ করেই তাদের ব্যবসা পরিচালনা করছে বলেও জানান তিনি।”

নিয়ম অনুযায়ী ১০ কিংবা তার অধিক তলাবিশিষ্ট ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে সামনে কমপক্ষে ২৫ থেকে ৩০ ফুট চওড়া রাস্তা থাকার কথা। ভবনের নকশা অনুমোদনের জন্য রাস্তার এই ন্যূনতম প্রস্থের পাশাপাশি অন্যান্য কিছু শর্তও পূরণ করতে হয়। এছাড়াও বহুতল ভবনের জন্য ফায়ার সেফটি (অগ্নি নিরাপত্তা) ব্যবস্থা থাকা আবশ্যক এবং এটি নকশা অনুমোদনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এছাড়াও ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে রাজউকের সকল নিয়ম-কানুন যেমন- বিল্ডিং কোড, ফ্লোর এরিয়া রেশিও (ঋঅজ) ছাড়াও নিয়ম অনুযায়ী নকশা অনুমোদন করা হয়েছে কিনা, এবং নকশার সকল শর্তাবলী মেনে চলা হচ্ছে কিনা- এসব বিষয়গুলো অনুমোদিত নকশায় উল্লেখ থাকে। কিন্তু, মাতুয়াইল এলাকায় নির্মাণাধীন বেশিরভাগ ভবন ঘুরে অনিয়মের বিষয়গুলো চোখে পড়েছে। কোন রাস্তা ছাড়াই হাঁটু কিংবা গলাপানিতে, বিলের মাঝখানে কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে ৬/৭ ফুট চিপা গলিতে ৮/১০ তলাবিশিষ্ট একাধিক ভবন চোখে পড়েছে।

জানা গেছে, রাজউক জোন-৬/২ এর আওতাধীন মাতুয়াইল এলাকায় গত ৭/৮ বছরে কম-বেশি প্রায় ৫ শতাধিক ভবনের নির্মাণকাজ (আংশিক-পূর্ণ) চলমান আছে। রাজউকের সবচাইতে ব্যস্ততম জোন-৬/২। বর্তমানে এই জোনের ইমারত পরিদর্শকের দায়িত্ব পালন করছেন অমিত হাসান। মাস তিনেক আগে অমিত হাসানকে এই জোনে বদলি করা হয়েছে। দায়িত্ব পেয়েই পুরো এলাকায় ‘অনিয়মের ছড়াছড়ি’ দেখে যারপরনাই আনন্দিত অমিত হাসান এখন মাতুয়াইল এলাকার ভবন মালিকদের কাছে রীতিমতো আতঙ্কে পরিণত হয়েছেন। অমিত হাসান এখন নিয়ম করে সাইট ভিজিটে যান। ভবন গুণে গুণে অনিয়ম খুঁজে বের করে একটার পর একটা নোটিশ ধরিয়ে সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছেন কোটি কোটি টাকা। মাত্র তিন মাসেই কয়েক কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন অমিত। কথিত আছে- ‘অমিতের মিটার নাকি কখনোই দুই লাখের নিচে নামে না। কোন ভবনের দিকে তাকালেই অমিতকে কমপক্ষে দুই লাখ টাকা দিতে হয়। টাকা না দিলে উচ্ছেদের নোটিশসহ নানা ধরনের হুমকী-ধমকী চলতে থাকে।’

এ বিষয়ে ইমারত পরিদর্শক অমিত হাসানের মুঠোফোনে কল দিয়ে জানতে চাইলে তিনি দৈনিক সময় প্রতিবেদকের কাছে কোনপ্রকার বক্তব্য দিতে রাজি হন নি।

পরবর্তীতে সংশ্লিষ্ট জোনের অথরাইজড অফিসার জান্নাাতুল মাওয়ার মোবাইলে কল দিলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।

উল্লেখ, সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মো. রিয়াজুল ইসলাম বলেন, নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে ঢাকায় নির্মাণাধীন ৩ হাজার ৩৮২টি ভবনের অবৈধ অংশ চিহ্নিত করে ভাঙা হবে, কাজগুলো শুরুও হয়েছে।

তিনি বলেন, অবৈধ ভবনগুলোর কাজ স্থগিত রাখতে নির্দেশ দিয়ে পর্যায়ক্রমে ভবনগুলো আংশিক অংশ ভেঙে ফেলা হবে। প্রথম ধাপে সেবা সংযোগ বিচ্ছিন্ন, ফৌজদারি মামলা দায়ের করা, নকশা বাতিল এবং প্রয়োজনে ভবনগুলো সিলগালা করা হবে।

তিনি আরও বলেন, রাজউক এলাকায় নির্মাণাধীন ৩ হাজার ৩৮২টি ভবন চিহ্নিত করেছি, যেগুলো নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়েছে। এই ভবনগুলোর যেটুকু অংশেই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়েছে, সেটুকু ভেঙে ফেলবো। আমি যতদিন দায়িত্বে আছি তারমধ্যে এই কাজ চালিয়েই যাবো। এগুলো ভেঙে হোক কিংবা অন্যভাবে হোক, তাদের নিয়মের মধ্যে আনবো। আমরা নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করছি।

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)
আরো পড়ুন

সর্বশেষ

জনপ্রিয়

নামাজের সময়সূচি

ওয়াক্ত সময়সূচি
ফজর ০৪:০৯ ভোর
যোহর ১২:০৫ দুপুর
আছর ০৪:৪২ বিকেল
মাগরিব ০৬.৪২ সন্ধ্যা
এশা ০৮:১ রাত

মঙ্গলবার ৫ আগস্ট ২০২৫