মঙ্গলবার, ১২ আগস্ট ২০২৫, ২৮ শ্রাবণ ১৪৩২


শূন্য থেকে কোটিপতি

ওয়াসার হারুনের এতো সম্পদ!

জেহাদ চৌধুরী//মামুন রশীদ

প্রকাশিত:১২ আগষ্ট ২০২৫, ১৯:৪৫

ছবি- দৈনিক সময়

ছবি- দৈনিক সময়

আন্ডার বিলিং, মিটার টেম্পারিং এবং অবৈধ পানির লাইন সংযোগে সহযোগিতার মাধ্যমে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে হাতিয়ে নেওয়া বিপুল অর্থে গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। ঢাকার মোহাম্মদপুরেই চারটি বাড়ি, আছে একাধিক ফ্ল্যাট ও গাড়ি। গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার পাগলা থানাধীন মাখল গ্রামে রাজকীয় প্রাসাদসহ বিঘায় বিঘায় জমি আছে তার। এককথায় ছোট খাটো একটা সাম্রাজ্যের মালিক ঢাকা ওয়াসার সাবেক মিটার রিডার বর্তমানে রাজস্ব পরিদর্শক হারুন অর রশিদ (রানা)। চাকরি জীবনের বিভিন্ন সময়ে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির একাধিক অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং ওয়াসা কর্তৃপক্ষ হারুনকে দায়মুক্তি দিয়েছে। সম্প্রতি ডিজিএফআই সদরদপ্তরে হারুনের নামে একটি অভিযোগ জমা পড়েছে। হারুন ও তার স্ত্রী-ছেলে-মেয়ে এবং আত্মীয়দের নামে-বেনামে কোটি কোটি টাকার সম্পদের বিবরণ আছে ওই অভিযোগে।

জানা গেছে, রাজস্ব পরিদর্শক হারুন অর রশিদ বর্তমানে ঢাকা ওয়াসার ২ নম্বর রাজস্ব জোনে কর্মরত আছেন। পূর্বে যে সকল জোনে ছিলেন- সেখানেও ব্যাপক দুর্নীতি করেছেন। ওয়াসার পিপিআই প্রকল্পের অন্যতম সুবিধাভোগী ছিলেন হারুন। বিত্তশালী এই রাজস্ব পরিদর্শক নিজে কোন ডিউটি করেন না। ব্যক্তিগত নিয়োগকৃত সহকারী মো. জাকিরসহ একাধিক ‘ডুপলি’ দিয়ে সাইট পরিচালনা করেন। অথচ বহিরাগত দিয়ে কাজ করানো সম্পূর্ণ বেআইনী উল্লেখ করে ২০১৮ সালের ৫ জুলাই ওয়াসা কর্তৃপক্ষ এক আদেশের মাধ্যমে বহিরাগত নিয়োগ নিষিদ্ধ করে (স্মারক নং রা/৮২০২ প্র:রা:ক:-৫/৭/২০১৮ইং)। হারুনের বেতন ৩৫ হাজার টাকা হলেও তিনি তার সহকারী ডুপলিকে বেতন দেন ২৫ হাজার টাকা এবং তার ড্রাইভারের বেতন ২৫ হাজার টাকা।

অভিযোগ মতে, রাজধানীর মোহাম্মদপুরের ৭/এ/১৫ টিক্কাপাড়ায় ১টি বাড়ি, ঢাকা উদ্যান ৩নং রোডে ৩৯নং ১টি ৪তলা বাড়ি, হোল্ডিং নং- এম/৮, নূরজাহান রোডে ১টি ২তলা বাড়ি এবং মোহাম্মদপুর চাঁন মিঞা হাউজিংয়ের ২নং রোডে ১টিসহ মোট চারটি বাড়ির মালিক হারুন। এছাড়া গাজিপুরের শ্রীপুর ও মাওনা, ময়মনসিংহের ভালুকা, পাইথল এবং গফরগাঁওয়ে তার অঢেল সম্পদ রয়েছে।

ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে, চাকরি জীবনের শুরু থেকেই নানা অনিয়ম-ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার সম্পদের পাহাড় গড়েছেন ময়মনসিংহের হতদরিদ্র মৃত রোছমত আলীর সন্তান হারুন অর রশিদ (রানা)। সামান্য একজন মিটার রিডার হয়ে কীভাবে তিনি এতো সম্পদের মালিক হলেন- বিষয়টি নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন হারুনের সহকর্মী থেকে শুরু করে তার নিজ গ্রামের মানুষ।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে হারনের এক সহকর্মী দৈনিক সময়কে বলেন, “রানা দম্ভ করে বলেন- তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে কোন লাভ হবে না। টাকা দিয়ে সবকিছু ম্যানেজ করে নিবেন।’

অভিযোগে জানা গেছে, হারুন অর রশিদ তার গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার পাগলা থানাধীন মাখল গ্রামের বিল মাখল মৌজায় বিলাশবহুল ২তলা বাড়ি বানিয়েছেন- যার বর্তমান বাজারমূল্য কোটি টাকার ওপরে। এছাড়াও রাজধানীর মোহাম্মদপুরের ৭/এ/১৫ টিক্কাপাড়ায় ১টি বাড়ি, ঢাকা উদ্যান ৩নং রোডে ৩৯নং ১টি ৪তলা বাড়ি, হোল্ডিং নং- এম/৮, নূরজাহান রোডে ১টি ২তলা বাড়ি এবং মোহাম্মদপুর চাঁন মিঞা হাউজিংয়ের ২নং রোডে ১টি বাড়িসহ মোট চারটি বাড়ির মালিক হারুন। গাজীপুর জেলার শ্রীপুর থানাধীন মাওনা পিয়ার আলী কলেজ সংলগ্ন ১টি টিন সেড বাড়ি, শ্রীপুর থানাধীন মাওনা হাসপাতাল রোড সংলগ্ন ১টি বাড়ি, মাওনা প্রশিকার মোড় সংলগ্ন ২টি টিনসেড বাড়ি, ভালুকা স্কয়ার মাস্টারবাড়ী ও জামিদার বাড়িতে ২টি টিনসেড বাড়ি, ভালুকা কাশর মৌজায় বাউন্ডারী করা ৩ একর জমি, পাগলা থানাধীন গয়েশপুর বাজারে ১টি বাড়ি এবং রেলওয়ের জমি দখল করে অবৈধভাবে ২০টি দোকান নির্মাণ করেছেন হারুন। গফরগাঁও থানার পাইথল মৌজায় ১ একর জায়গার উপর একটি মুরগীর খামার আছে তার। পাইথল মৌজায় দাখিল মাদরাসা রোডে ১টি বাড়ি, গফরগাঁও উপজেলা শিলাশী মৌজায় ৩/৪ শতাংশ জমি আছে যার আনুমানিক মূল্য ৬০ লক্ষ টাকা।

এখানেই শেষ নয়! হারুন অর রশিদ তার গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের বিল মাখল মৌজায় বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে নিজের এবং তার স্ত্রী-ছেলে-মেয়ে ও আত্মীয়দের নামে-বেনামে কোটি কোটি টাকার চাষী জমি কিনেছেন। যার মধ্যে আবুল হাসমে ও সুরুজ গংয়ের কাছ থেকে (দাগ নম্বর ৫৩২০) ৪ কাঠা জমি- মূল্য ২ লাখ টাকা। মোতালেব গংয়ের কাছ থেকে (দাগ নম্বর ৫২৮৪) দেড় লাখ টাকায় ৪ কাঠা, আবুল হাসেম গংয়ের (দাগ নম্বর ৫২৮০) কাছ থেকে দেড় লাখ টাকায় ৩ কাঠা, একই ব্যক্তির কাছ থেকে ৫৫৩৮ ও ৫৫৩৯ দাগে ২ লাখ টাকা দিয়ে আরও ৪ কাঠা, মিরাজ মেম্বার গংয়ের (দাগ নং ৫৫৪০) কাছ থেকে দেড় লাখে ২.১/২ কাঠা, আঃ রহমান গংয়ের কাছ থেকে (দাগ নং- ৫২১০, ৫২১২) ৪ লাখ টাকায় ৮ কাঠা, আঃ হেকিম গংয়ের কাছ থেকে ৪ দাগে (৫১৫৪, ৫১৬৪, ৫২৪৩, ৫২৪১) ৩ লাখ টাকা দিয়ে ৬ কাঠা, মোতালেব গংয়ের কাছ থেকে তিন দাগে (নং-৫২০৬, ৫২০৭, ৫১৬৫) ৪ লাখ টাকা দিয়ে ৮ কাঠা, নাজিম উদ্দিন গংয়ের কাছ থেকে তিন দাগে (৫১৬৩, ৫২০৯, ৫২৪২) ৩.১/২ কাঠা- যার মূল্য পৌনে ২ লাখ টাকা এবং একই মৌজায় ৫২৩৯, ৫২২৫ নং দাগে ওমর আলী গংয়ের কাছ থেকে এক লাখ টাকা দিয়ে ২ কাঠা, নূরুল ইসলাম গংয়ের কাছ থেকে ১ লাখ টাকায় ২ কাঠা (দাগ নং- ৫২৩১), আঃ খালেক গংয়ের কাছ থেকে ১ লাখ টাকায় ২ কাঠা (দাগ নং-৫২৩০), ৫টি দাগে (৫২৭৬, ৫৯২৪, ৫২২৬, ৫২২৭, ৫২২৮) কালাম হাফেজ গংয়ের কাছ থেকে ৩ লাখ টাকায় ৬ কাঠা এবং আবু সাঈদ গংয়ের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা দিয়ে (নিওয়ারী মৌজা, দাগ নং- ৫৯০) ১ কাঠা জায়গা কিনেছেন। এছাড়াও একই মৌজায় মোট ১১ দাগে (২২০, ২২১, ৫৮৩, ৫৮৫, ৫৮৭, ৫৮৮, ৫৮৯, ৫৯১, ৫৯২, ৫৯৩, ৫৭৭) হাসমত গংয়ের কাছ থেকে ৬ লাখ টাকায় ১২ কাঠা জায়গা কিনেছেন হারুন।

অভিযোগে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ময়মনসিংহের বিল মাখল মৌজায় লুতফর ঢালী, বারেক ঢালী, তোফাজ্জল ঢালী ও কামাল এর নিকট থেকে ৫ লাখ টাকায় ১ একর, ইব্রাহিম খানের কাছ থেকে ২ লাখ টাকায় ৪ একর, শুকুর মাহমুদের কাছ থেকে ৫ লাখ টাকায় ১ একর, আঃ রশিদ ও ইসমাইল এর কাছ থেকে ২ লাখ টাকায় ২ একর, রগু বাড়ির আঃ মোতালেব, আঃ কাশেম, হাফিজ উদ্দিন এর নিকট থেকে ৯ লাখ টাকায় দেড় একর, মোঃ আঃ রহমান, আলাউদ্দিন, মুর্শিদ, হেলাল উদ্দিন এর নিকট থেকে ৬ লাখ টাকায় ১ একর জমি কিনেছেন হারুন অর রশিদ। এছাড়াও একই মৌজা এলাকায় কাজিম উদ্দিন, আলিম উদ্দিন, নাজিম উদ্দিন ও খোকা মিয়ার নিকট থেকে ১০ লাখ টাকায় ২ একর, আঃ হেকিম, আঃ বাতেন, ফারুক মিয়া ও হাতেম আলীর নিকট থেকে ৮ লাখ টাকায় ১ একর, বাড়ই বাড়ির রুস্তম আলী, আঃ কালাম এর নিকট থেকে ৩ লাখ টাকায় ৪ কাঠা, গুজাবাড়ির আবুল কালাম ও হাফেজ এর নিকট থেকে ২ লাখ টাকায় ৬ কাঠা, ছফির উদ্দিন, নুরুল ইসলামের কাছ থেকে ৫ লাখ টাকায় ১০ কাঠা এবং উমর আলী ও আঃ বারেকের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকায় ৫ কাঠা জায়গা কিনেছেন বলেও অভিযোগে উল্লেখ আছে। এছাড়াও গাজীপুরের শ্রীপুর এবং ময়মনসিংহের ভালুকাতেও অনেক চাষী জমি আছে হারুনের।

অভিযোগ মতে, প্রতারণা করে সামান্য টাকার বিনিময়ে মরহুম আবু তাহেরের স্ত্রী-পুত্র-মেয়ের কাছ থেকে বাড়ি-ভিটাসহ কবরস্থান লিখে নিয়েছেন হারুন। একইভাবে নুরুল ইসলাম, গিয়াস উদ্দিন, সামছুদ্দিনদেরকে বিভিন্ন ভয়ভীতি দেখিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে ভিটাবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করেছেন তিনি। অভিযোগ আছে, হারুনের বিরুদ্ধে কেউ কোন লোক কথা বললেই তাকে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানী করে। থানা পুলিশ তার কব্জায়। যে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করবে, তাকেই সায়েস্তা করা হবে- এমন হুমকি প্রায়ই দিয়ে থাকেন তিনি। সে ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় ভুয়া মামলায় জড়িয়ে অনেক লোককে হয়রানি করেছে। হারুন সবসময় গর্ব করে বলেন- কেউ আমার একটা পশমও ছিড়তে পারবে না। টাকা দিয়ে সব ম্যানেজ করে ফেলবো।

সূত্র মতে, ঢাকায় হারুনের প্রতিটা বাড়িই বিলাশবহুল প্রাসাদতুল্য। আধুনিকতার কোন কমতি নেই তার প্রাসাদে। হারুনের স্ত্রী-কন্যার ব্যবহারের জন্য স্বর্ন আছে শত ভরির উপরে। একাধিক গাড়ির মালিক হারুন নিজে চড়েন (ঢাকা মেট্রো-গ-১৭-৪৭৬৩০ গাড়িতে। তার নিজ নামে, স্ত্রী-ছেলে-মেয়েদের নামে পোষ্ট অফিসসহ বিভিন্ন ব্যাংকে কোটি টাকা ডিপোজিট আছে। এক কথায় জিরো থেকে কোটি কোটি টাকার মালিক ঢাকা ওয়াসার সাবেক মিটার রিডার বর্তমানে রাজস্ব পরিদর্শক হারুন অর রশিদ ওরফে রানার উত্থান যেন আলাদীনের চেরাগের দৈত্যের গল্পকেও হার মানিয়েছে।
সূত্র জানায়, বিগত আওয়ামী লীগ সরকার আমলে হারুনের বিভিন্ন অপকর্ম আর অনিয়ম-দুর্নীতি উল্লেখ করে দুদকসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে একাধিকবার অভিযোগ করা হলেও অদৃশ্য কারনে হারুনের টিকিটি স্পর্শ করতে পারে নাই কেউই। ফ্যাসিস্টের দোসর হারুন টাকার জোর আর ক্ষমতার দাপটে সবকিছু ম্যানেজ করে রাখতেন। কথিত রয়েছে- একাধিকবার মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে দুদক থেকে দায়মুক্তির সনদ নিয়েছেন হারুন।

সার্বিক বিষয়ে জানতে হারুন অর রশিদের মোবাইল ফোনে কল দিলে তিনি দৈনিক সময়কে বলেন, ‘এগুলা পুরান কাহীনি। আমার স্থাবর-অস্থাবর সবকিছু ট্যাক্স ফাইলে উল্লেখ করা আছে। দুদক আমাকে বহুবার ডেকেছে। একাধিকবার আমার বিষয় নিয়ে তদন্ত করে কোন কিছু না পেয়ে দুদক আমাকে সার্টিফিকেটও দিয়েছে। এলাকার কিছু শত্রু আমাকে হয়রাণির উদ্দেশ্যে কয়দিন পরপর দুদকসহ বিভিন্ন দপ্তরে আমার নামে একই অভিযোগ করে। দুদকের তদন্তে আমার বিরুদ্ধে সকল অভিযোগ অসত্য প্রমাণিত হয়েছে।”

সম্পর্কিত বিষয়:

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)
আরো পড়ুন

সর্বশেষ

জনপ্রিয়

নামাজের সময়সূচি

ওয়াক্ত সময়সূচি
ফজর ০৪:১২ ভোর
যোহর ১২:০৪ দুপুর
আছর ০৪:৪০ বিকেল
মাগরিব ০৬.৩৮ সন্ধ্যা
এশা ০৭:৫৫ রাত

মঙ্গলবার ১২ আগস্ট ২০২৫