রবিবার, ১৫ জুন ২০২৫, ৩১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২


নগর উন্নয়ন প্রকল্পের ৪২৫ কোটি টাকা গচ্ছা

অর্থনৈতিক প্রতিবেদক

প্রকাশিত:১৪ জুন ২০২৫, ১৬:৪৭

ছবি সংগৃহীত

ছবি সংগৃহীত

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের আওতায় ৪৪৫ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পে লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে। নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ নামে এই প্রকল্প ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের নেওয়া।

শুধু অভিযোগ নয়, ৬ বছরের প্রকল্প ১১ বছর পার হলেও ফলাফল ছিল প্রায় শূন্য। অথচ প্রকল্পের সবচেয়ে বড় ফান্ড এসেছে বিশ্বব্যাংকের ঋণে। তারপরও প্রকল্পের বেশির ভাগ ফলাফল মুখ থুবড়ে পড়েছে, যা সংশ্লিষ্টরা নিচকই অর্থের গচ্ছা হিসেবে দেখছেন।

যেমনটা ২০২৩ সালে সরকারি সংস্থা বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) অভ্যন্তরীণ তদন্তে উঠে এসেছিল। যদিও লুটপাটের প্রমাণ পাওয়ার পরও কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এবার লুটপাটের সেই অভিযোগ খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরই অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে অনুসন্ধান কর্মকর্তা সহকারী পরিচালক মো. সহিদুর রহমান ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, পরিবেশ অধিদপ্তর, ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে বিভিন্ন নথিপত্র তলব করে চিঠি দিয়েছেন বলে জানা গেছে।

নথিগুলোর মধ্যে রয়েছে—নির্মল বায়ু ও পরিবেশ ফেস প্রকল্প বাস্তবায়ন সংক্রান্ত (১) ডিপিপি (২) প্রাক্কলন, (৩) প্রকল্প অনুমোদনপত্র, (৪) জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি, (৫) শিডিউল বিক্রয় রেজিস্ট্রার, (৬) দরপত্র খোলার বিবরণী, দরপত্র উন্মুক্ত পত্র ও তুলনামূলক বিবরণী, (৭) দরপত্র কমিটি গঠন পত্র ও দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি গঠনপত্র (একাধিক হলে সবগুলো) এবং দরপত্র মূল্যায়ন প্রতিবেদন ও সুপারিশ, (৮) প্রকল্পের খাত অনুযায়ী প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বছরভিত্তিক বরাদ্দ ও মোট বরাদ্দ অর্থাৎ অনুমোদিত প্রাক্কলন বা প্রাক্কলিত মূল্য, (৯) দরপত্র অনুমোদন পত্র, (১০) নোটিফিকেশন অব আওয়ার্ড, ঠিকাদারের সম্মতিপত্র, চুক্তিপত্র, কার্যাদেশ, (১১) প্রকল্পভিত্তিক পরিমাপ বই এবং চলতি ও চূড়ান্ত বিল, (১২) প্রকল্প সমাপ্তির পর আইএমইডি কর্তৃক পিসিআর সমাপ্তি প্রতিবেদন, (১৩) প্রকল্প সংশ্লিষ্ট নথির নোটশিটসহ অন্যান্য রেকর্ডপত্র এবং (১৪) প্রকল্পের খাত অনুযায়ী প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বছরভিত্তিক বরাদ্দ ও মোট বরাদ্দ অর্থাৎ অনুমোদিত প্রাক্কলন বা প্রাক্কলিত মূল্য ইত্যাদি।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুদকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা (পরিচালক) বলেন, গত মাসে নথিপত্র তলব করে চিঠি দেওয়া হয়। এরই মধ্যে বেশকিছু নথিপত্র দুদকে পৌঁছেছে। আমাদের অনুসন্ধান কর্মকর্তা ওইসব নথিপত্র যাচাই-বাছাই করছেন। অভিযোগ সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র দেখে মনে হয়েছে প্রকল্প বাস্তবায়নে বড় ধরনের অনিয়ম রয়েছে।

অন্যদিকে দুদক মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দুদকের অনুসন্ধান প্রক্রিয়া অনুসন্ধান কর্মকর্তা তার প্রয়োজনে যে কোনো নথিপত্র তলব করতে পারে। এটি সম্পূর্ণ তার এখতিয়ার। কমিশন দালিলিক প্রমাণের ভিত্তিতেই পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ নেবে।

আওয়ামী সরকারের শাসনামলে ২০০৯ সালে নেওয়া ‘নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ’ প্রকল্পের সময় ও ব্যয় দুটোই বৃদ্ধি করা হয়। ৬ বছরের প্রকল্প শেষ হয় ১১ বছরে। যেখানে ৪৪৫ কোটি টাকার প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে ৮০০ কোটি টাকা করা হয়। যদিও শেষ পর্যন্ত ৪২৫ কোটি টাকা খরচ করে প্রকল্পের ইতি টানা হয়েছিল। সরকারি সংস্থা বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) অভ্যন্তরীণ তদন্তেও অনিয়মের প্রমাণ মিলেছে বলে জানা গেছে।

আইএমইডি তদন্তে যা উঠে এসেছে

২০২৩ সালের জুনে করা আইএমইডির তদন্ত প্রতিবেদন ইতোমধ্যে দুদকে এসেছে বলে জানা গেছে। ওই প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, গুলশান-১ লিংক রোড ইন্টারসেকশন অটো কন্ট্রোল ট্রাফিক সিস্টেম চালু নেই এবং সৌরবিদ্যুৎ অকার্যকর। একই অবস্থা হাউজবিল্ডিং কলোনি ইন্টারসেকশন, ঝিগাতলা, সাতমসজিদ রোড (শংকর) ইন্টারসেকশন এবং বনানী রোড-১১ নম্বর ইন্টারসেকশনে। জসীমউদ্দীন রোড ইন্টারসেকশনে ফ্লাইওভারেও সৌরবিদ্যুৎ অকার্যকর। এছাড়া গুলশান-২ রোডে রিমোট কন্ট্রোল সিস্টেম চালু থাকলেও সৌরবিদ্যুৎ সিস্টেম অকার্যকর।

ফুটওভার ব্রিজের অবস্থা সম্পর্কে বলা হয়, শাহজাদপুর ফুটওভারব্রিজ অবৈধ হকারদের দখলে থাকায় জনগণের চলাচলে সমস্যা হচ্ছে। এছাড়া সিঁড়ির উচ্চতা বেশি হওয়ায় বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ওঠানামা করতে অসুবিধা হচ্ছে। একই অবস্থা বিরাজ করছে বনানী-কাকলী, শ্যামলী, বসুন্ধরা শপিংমল, সোবাহানবাগ মসজিদ, নর্দা-বারিধারা বাসস্ট্যান্ড এবং উত্তর বাড্ডা বাজার ফুটওভারব্রিজে। এছাড়া পীরজঙ্গী মাজার এবং কমলাপুরের ফুটওভারব্রিজের ল্যান্ডিং সিঁড়ি একপাশে হওয়ায় যাতায়াতে সমস্যায় পড়তে হয়। একই অবস্থা মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়সংলগ্ন ফুটওভারব্রিজেও। বনানী ১১ নম্বর রোডে ফুটওভারব্রিজের চলন্ত সিঁড়ি সব সময় কার্যকর থাকে না।

প্রতিবেদনে ফুটপাত সম্পর্কে বলা হয়, লালমাটিয়া ব্লক-ই বাবরী মসজিদ রোডের ফুটপাতের ভাঙা অংশ সংস্কার করা হয়নি। রাস্তায় অবৈধ দোকান বসানোর কারণে যানজট তৈরি হচ্ছে। ফুটপাতের প্রশস্ততা প্রয়োজনের তুলনায় কম। এছাড়া লালমাটিয়ার ব্লক-‘ডি’তে ২৯৩ মিটার ফুটপাত ও রোড ডিভাইডারের কাজ করা হয়েছে, ফলে রাস্তা সরু হয়ে যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। যদিও রাস্তার ফেরিওয়ালা এবং অনিয়ন্ত্রিত পার্কিংও দায়ী। শেরশাহ সুরি রোডে ৫১৩ মিটার রাস্তায় মালামাল রেখে ফুটপাত দখল করা হয়েছে। রিংরোড থেকে কলেজগেট পর্যন্ত রাস্তায় অযাচিত গ্যারেজ ও খাবারের দোকান থাকায় কলেজ ছুটির সময় মাঝেমধ্যে যানজট হয়।

অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের আওতায় মূল প্রকল্পের মোট ব্যয় ছিল ৪৪৫ কোটি ১৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিলের ৫১ কোটি ৮৪ লাখ এবং বিশ্বব্যাংকের ঋণ থেকে ৩৯৩ কোটি ১৭ লাখ টাকা ব্যয় করার কথা ছিল। কিন্তু তিনবার সংশোধনের পর ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৮০২ কোটি ৫২ লাখ টাকা। প্রকল্পের মেয়াদ ছিল ২০০৯ সালের জুলাই থেকে ২০১৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। কিন্তু বারবার মেয়াদ বাড়িয়ে এটি শেষ করা হয় ২০১৯ সালের জুনে। প্রকল্প বাস্তবায়ন শেষে মোট খরচ হয়েছে ৪২৫ কোটি ৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি ৬ কোটি ৮৩ লাখ এবং বৈদেশিক ঋণের ৪১৮ কোটি ২১ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের ঋণ শোধ করতে হচ্ছে জনগণকে, অথচ দোষীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। প্রকল্পটিতে পদে পদে অনিয়ম ও দুর্নীতি করার অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে প্রকল্পটি জনস্বার্থে যে উদ্দেশ্যে নেওয়া হয়েছিল, এর অনেক কিছুই বাস্তবে কাজে লাগেনি। প্রকল্পের মূল কাজের মধ্যে ছিল রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনে অটো সিগন্যাল, সোলার সিস্টেম, ফুটপাত, ফুটওভার ব্রিজ ও ফুটওভার ব্রিজে চলন্ত সিঁড়ি স্থাপন এবং সংশ্লিষ্ট কিছু রাস্তার উন্নয়ন। কিন্তু প্রকল্পের আউটপুট খুবই কম মিলেছে। ছিল না কোনো মনিটরিং ও জবাবদিহিতা।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করে আইএমইডির একজন কর্মকর্তা বলেন, এমন গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের কোনো যথাযথ পরিকল্পনা ছিল না। ফলে বাস্তবায়ন পরবর্তী সময়ে কীভাবে এর ব্যবস্থাপনা করা হবে, সেটা নিয়ে কেউ ভাবেনি। এখানেও সেটাই হয়েছে। প্রকল্পে উন্নয়নের নামে অপচয় হয়ে গেছে। ‘ন্যাশনাল ইভ্যালুয়েশন পলিসি’ অনুমোদিত হলে ভবিষ্যতে এই ধরনের অনিয়মের বিরুদ্ধে আইনি বাধ্যবাধকতা তৈরি হবে বলে মনে করছি।

সম্পর্কিত বিষয়:

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)
আরো পড়ুন

সর্বশেষ

জনপ্রিয়

নামাজের সময়সূচি

ওয়াক্ত সময়সূচি
ফজর ০৩:৪৪ ভোর
যোহর ১১:৫৯ দুপুর
আছর ০৪:৩৯ বিকেল
মাগরিব ০৬:৫০ সন্ধ্যা
এশা ০৮:১৪ রাত

রবিবার ১৫ জুন ২০২৫