সোমবার, ১০ নভেম্বর ২০২৫, ২৬ কার্তিক ১৪৩২
ছবি : সংগৃহীত
২৫ অক্টোবর ২০২৫, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগের ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপনের মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হলো পূর্ণাঙ্গ পুনর্মিলনী। ৭২ বছরের ইতিহাসের ধারায় এটি ছিল এক অনন্য মাইলফলক। এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন দেশের প্রধান বিচারপতি, যিনি উপস্থিতি ও বক্তৃতার মাধ্যমে পুরো অনুষ্ঠানকে এক অনন্য মর্যাদা প্রদান করেছেন। তার বক্তব্যে প্রতিফলিত হয়েছে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, ন্যায় প্রতিষ্ঠা, রাষ্ট্রের নৈতিকতা এবং দেশের আইন শিক্ষার ভবিষ্যৎ যা একাধারে শিক্ষার্থীদের জন্য অনুপ্রেরণা, প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের জন্য গৌরব এবং জাতির জন্য দিকনির্দেশনার আলো হয়ে উঠেছে।
প্রধান বিচারপতির ভাষণে উঠে এসেছে যে আইন শুধু নিয়ম বা বিধি নয়, এটি মানুষের মর্যাদা, ন্যায় ও সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতিফলন। তিনি বললেন, “বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের নৈতিক বিবেক এবং এটি জনগণের জন্য প্রতিষ্ঠিত। এটি ক্ষমতার হাতিয়ার নয়, বরং ন্যায়ের অভ্যন্তরীণ শক্তি, যা সমাজের সবচেয়ে দুর্বল ও প্রান্তিক মানুষদের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য।”
তার বক্তৃতা স্পষ্ট করে দেখিয়েছে যে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সাংবিধানিক অঙ্গীকার; যা কার্যকর হলে জনগণ নিশ্চিতভাবে ন্যায়ের প্রকৃত অভিজ্ঞতা পাবে।
এই অনুষ্ঠানে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে প্রধান বিচারপতির কিছু জোরালো বার্তা। বিচার বিভাগকে কেবল প্রশাসনিক কাঠামো হিসেবে নয়, বরং নৈতিকভাবে দৃঢ় এবং জনগণের আস্থা অর্জনের যোগ্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। তিনি সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়, বিচারকদের বাজেট ও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ, ডিজিটাল কেস ম্যানেজমেন্ট এবং ই-জুডিশিয়ারির মাধ্যমে জনমুখী বিচার নিশ্চিত করার উদ্যোগের কথাও তুলে ধরেন। এটি কেবল প্রশাসনিক সংস্কার নয়; এটি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ এবং ২০২৪ সালের নৈতিক পুনর্জাগরণের প্রত্যক্ষ বহিঃপ্রকাশ।
এখানে প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য—
“২০২৫ সালের সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশকে অন্তঃসরকারি মন্ত্রিসভা কর্তৃক মাত্র দুই দিন আগে অর্থাৎ ২৩ অক্টোবর যে ‘নীতিগত অনুমোদন’ দেওয়া হয়েছে, তা একটি সুপরিকল্পিত বহুপাক্ষিক প্রয়াসের ফল। ১৫ মাসে এই প্রয়াসে প্রধান বিচারপতির কার্যালয়ের কৌশলগত অবস্থান এই অন্তর্বর্তী সরকারের নির্বাহী শাখার সাথে মিলে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এবং তা আগামী দিনগুলোতেও অব্যাহত থাকবে।
অতএব, এখন থেকে সংশ্লিষ্ট সব অংশীজন পরবর্তী সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনসমূহ, সারাদেশের বার কাউন্সিলসমূহ এবং বিশেষত সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও জেলা আদালত এবং ম্যাজিস্ট্রেসির বিচারকবৃন্দ এবং বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন এদের প্রত্যেকের জন্যই এ ধরনের কাঠামোগত রূপান্তরের টেকসই বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক।
এটি উপলব্ধি করতে হবে যে আমরা সবাই এখানে একটি ‘quid pro quo’ বা পারস্পরিক দায়বদ্ধ সম্পর্কের মধ্যে আবদ্ধ। পারস্পরিকতা, যুক্তিনিষ্ঠতা এবং ‘one-upmanship’ বা একে অপরকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা পরিহার এই তিনটি নীতি হওয়া উচিত সম্পর্কের মূল ভিত্তি, যা বিচার বিভাগের স্বায়ত্তশাসনের স্থায়িত্ব নিশ্চিত করবে। অবিশ্বাস কিংবা একতরফা সিদ্ধান্ত গ্রহণের সামান্য ইঙ্গিতও ১৫ মাস ধরে যে প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতার স্থাপত্য আমরা গড়ে তুলেছি, তা বিপন্ন করে দিতে পারে।”
বক্তৃতায় প্রধান বিচারপতি আরও বলেন, “আইন কেবল শাসনের হাতিয়ার নয়; এটি মানুষের মর্যাদা, সহমর্মিতা এবং ন্যায়বোধের প্রতিফলন।”
বিচারকের কাজ শুধুমাত্র আইন প্রয়োগ নয়; এটি সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠা, মানবিক সহমর্মিতা এবং সামাজিক ন্যায়বোধ রক্ষার নৈতিক দায়িত্ব বহন করে। শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে তার পরামর্শ, “আইন শিক্ষার আসল মানে কেবল পেশাগত দক্ষতা অর্জন নয়; এটি একটি নৈতিক অঙ্গীকার, একটি আস্থা, একটি সাংবিধানিক এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা।”
৭২ বছরের এই উত্তরণে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগ ন্যায় প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে এক উজ্জ্বল বাতিঘর। প্রধান বিচারপতির উপস্থিতি এবং বক্তব্য প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের মনে নতুন উদ্দীপনা সঞ্চার করেছে, প্রমাণ করেছে আইন শিক্ষার যাত্রা আদালতে শেষ হয় না; এটি মানুষের জীবন, সমাজ এবং রাষ্ট্রের নৈতিক ভিত্তিকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে সম্পূর্ণতা লাভ করে।
এই প্রথম পুনর্মিলনী এবং প্রধান বিচারপতির দূরদর্শী বার্তা আমাদের মনে করিয়ে দেয়—আইন শিক্ষা ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা একটি স্রোতস্বিনী নদীর মতো, যা যুগে যুগে সমাজকে সঞ্জীবিত করে এসেছে। বিচারপতির দৃঢ় উচ্চারণ “ন্যায় প্রতিষ্ঠা শুধু আদালতের দায়িত্ব নয়; এটি আমাদের সকলের নৈতিক অঙ্গীকার”।
২৫ অক্টোবরের এই অনন্য দিনটি প্রমাণ করেছে বাংলাদেশের বিচার বিভাগের যেই প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা ধীরে ধীরে বাস্তবে রূপ নিচ্ছে, তার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে মাননীয় প্রধান বিচারপতির প্রজ্ঞা, নৈতিকতা ও দৃঢ় নেতৃত্ব। তার এই দৃষ্টিভঙ্গি দেশের বিচার ব্যবস্থা আরও মানবিক, স্বচ্ছ ও জনগণের ন্যায়প্রাপ্তির যাত্রাকে মজবুতভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবে এটাই প্রত্যাশা।
এস. এম. সাদাকাত মাহমুদ : সহকারী রেজিস্ট্রার, হাইকোর্ট বিভাগ, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট; সাবেক শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)