বুধবার, ১৩ আগস্ট ২০২৫, ২৯ শ্রাবণ ১৪৩২


সাদা পাথর লুটের মহোৎসব ও দায়হীনতার সংস্কৃতি

ড. মোহাম্মদ আলী ওয়াক্কাস

প্রকাশিত:১৩ আগষ্ট ২০২৫, ১৩:৩১

ছবি সংগৃহীত

ছবি সংগৃহীত

প্রকৃতির অপরূপ লীলা এবং সৌন্দর্য বিধাতার শ্রেষ্ঠ আশীর্বাদ। নয়নাভিরাম স্নিগ্ধতার টানে নিয়ত ভ্রমণ পিপাসুরা এসবে ভিড় জমায়। মনের খোরাকের পরিপূর্ণতায় সিক্ত হয়ে মানুষেরা সমাজ অর্থনীতি এবং উন্নয়নে নিজেকে উজাড় করার সুযোগ পায়। এ যেন স্বর্গীয় মোহনীয় প্রশান্তি। এখানটায় সব শ্রেণি পেশার মানুষ সমান তালে সুখ আস্বাদন করে প্রশান্তির ঢেকুর তোলে। সময়ের বাঁকে এসবে এখন বৈশ্বিক প্রভাব ও লক্ষণীয়। রাষ্ট্র ও সরকার নিরাপদ পর্যটকবান্ধব এবং সর্বোপরি ট্যুরিজম শিল্প বিস্তৃতির অপার সম্ভাবনার সুযোগে সামাজিক ও অর্থনৈতিক দ্বার উন্মোচনের মাঝেই সার্থকতা খুঁজে।

এসবের লীলাভূমি পর্যটন সাম্রাজ্য সিলেট যেন অনেকটাই পর্যটকদের আলাদা নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছে। পাহাড়, চা বাগান, হাওর টিলা, বিছানাকান্দি জলাবন, সাদা পাথর, জাফলং এবং লালাখালে প্রতিনিয়ত লাখে-লাখে পর্যটক আসছে। এ যেন এক মোহনীয় পরিবেশ। পালাবদলের সংস্কৃতিতে সাদা পাথরে আজ শকুনির থাবা। সাদা পাথরের শুভ্রতা বিলীন হওয়ার পথে। ষড়যন্ত্রের পেছনে কারা কলকাঠি নাড়ছে? পর্যটক শূন্য জনপদ তৈরিতে কার লাভ? কর্তৃপক্ষের গা সওয়া ভাব কেন? কোথায় যেন বিভ্রান্তি? এসবের হেতু কী? প্রভাব এবং ফলাফল বুঝতে কি গবেষণার প্রয়োজন আছে? লুটেরারা এত আশকারা পায় কীভাবে? প্রতিবছর সাদা পাথর কি বিরান ভূমি হওয়ার পথে? কিন্তু কেন? সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সীমান্ত ঘেঁষে ধলই নদীর উৎস মুখে জিরো পয়েন্টের দশ নম্বর এলাকা সাদা পাথর হিসেবে পরিচিত। ২০১৭ সালেই মূলত এ এলাকার পরিচিতি দেশ বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় পাঁচ একর জায়গায় ভারতের মেঘালয় থেকে বানের ঢলে ভেসে আসা পাথরের স্তূপে এ অঞ্চলের গোড়াপত্তন। এখানটায় বোমা মেশিন এবং সনাতনী পদ্ধতিতে ও পাথর আহরণ বারণ আছে। পাহাড়, পাথর ও জলের টানেই হাজার হাজার ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে অতি কদরের জায়গা করে নেয় সাদা পাথর।

সাম্প্রতিক সময়ে ইলেকট্রনিক্স এবং প্রিন্ট মিডিয়ায় বহুল প্রচারিত সংবাদ, সাদা পাথর লুট। এ যেন নিত্যকার বিষয়। বিশেষত ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট থেকে ৭ আগস্ট পাথর চুরির মচ্ছব জাতিকে বিব্রত এবং লজ্জিত করেছিল। ফ্যাসিবাদের পতনের পরপর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর শিথিলতা এবং জনরোষের সুযোগে পরিবেশখেকো মানুষরূপী হায়েনাদের নগ্ন লীলায় ক্ষতবিক্ষত হতে থাকে সাদা পাথর। এ রেশ আজও থামেনি। নতুনভাবে দস্যুরা সক্রিয়। এ জনপদকে মরুভূমি করার পথেই যেন এরা মাঠে। এদের কোন দল বা ধর্মের তকমায় ট্যাগ দেওয়া উচিত হবে না। এরা অপরাধী অমানুষ এবং শয়তান।

পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা নাগরিকের দায়িত্ব। এসব লঙ্ঘনে জবাবদিহিতা এবং আইন অমান্যের শাস্তির বিধান রয়েছে। পরিবেশ-প্রতিবেশ দেশের প্রাণ। এসবে যারা থাবা বসায় তারা মানবতার শত্রু। সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানী মার্গারেট মিড (Margaret Mead)-এর আশঙ্কা, পরিবেশ ধ্বংস করলে আমাদের সমাজ থাকবে না। ওয়ান্ডেল বেরি (Wendell Berry)-এর পর্যবেক্ষণ, পরিবেশ ধ্বংসের মানে হলো নিজের সন্তানের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করা। অথচ আমরা প্রতিনিয়ত পরিবেশ বিপর্যয়ের অংশীজন হচ্ছি। জলবায়ু পরিবর্তন, বৈশ্বিক উষ্ণতা, খরা, বন্যা, জলোচ্ছ্বাসে, মানবসৃষ্ট কারণ অনেকাংশের দায়ী।

প্রতিদিন সাদা পাথরে হাজার হাজার শ্রমিক শাবল, বেলচা, কোদাল দিয়ে মাটি খুঁড়ে পাথর আহরণের মাঝেই সাদা পাথরকে বিবর্ণ করে দিচ্ছে। দিনভর পাথর তোলার মাঝেই তাদের রুটিরুজির জোগান বলবেন কী করে? খোদ পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার ভাষায় একদম ক্লিয়ার কেস অব এক্সপ্লয়টেশন। বরং এখানটায় যদি ইকো-ট্যুরিজম গড়ে তোলা যেত তাদের আয় অনেক গুণে বেড়ে যেত এবং পরিবেশ ও প্রতিবেশ সুরক্ষা পেত। বাংলাদেশে পাথর ব্যবহারের মোট ৯৪ শতাংশ জোগান মূলত আমদানি নির্ভর এবং মাত্র ৬ শতাংশ দেশীয় জোগান। ৯৪ শতাংশ আমদানি করার মাঝে কেন মাত্র ৬ শতাংশের প্রতি এত টান? এ লোভ অভয়ারণ্যের তিলকে স্রেফ আঘাত। এসবের পেছনের শক্তি হলো মাফিয়া চক্র। বর্তমান সময়ে এরা বেশ সক্রিয়। যেন দেখার কেউ নেই। সর্বত্র যেন অরাজকতা। সমন্বয়হীনতার জাল এতই বিস্তৃত এসবের ফাঁকফোকর গলে সবাই বেরিয়ে যাচ্ছে।

সাদা পাথর তুমি কার? এ প্রশ্ন সবার মুখে মুখে। কেউ দায়িত্ব নিতে চায় না। পরিবেশ মন্ত্রণালয় জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় প্রশাসনের দড়ি টানাটানিতে এ অঞ্চল সহসাই পর্যটন বিমুখ হতে বাধ্য। এসবে লাভ কার? ভিনদেশী হেজেমনি কি ভর করল? ভাববার বিষয়? প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে তালিকাভুক্তি না থাকায় পরিবেশ অধিদপ্তরের এখানটায় প্রভাব ও কাজ করার সুযোগ কম। খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর এসবে নজরদারি এবং ব্যবস্থাপনার আইনগত কর্তৃত্ব। তথাপি এ প্রতিষ্ঠানের অভিযান এবং কার্যক্রম দৃশ্যত না থাকায় লুটেরারা বেপরোয়া। জেলা প্রশাসনের উদাসীনতা, সমন্বয়হীনতা এবং মাঠ পর্যায়ে কাজের অনভিজ্ঞতার সুযোগে বিলীন হওয়ার পথে সাদা পাথর। সাদা পাথর আকর্ষণীয় পর্যটন এলাকা। এখানটায় যদি ইকো ট্যুরিজম গড়ে তোলা যায় এবং স্থানীয় মানুষের সম্পৃক্ততায় প্রতিবেশ পরিবেশ সুরক্ষার পাশাপাশি কায়িক শ্রমের পরিবর্তে এলাকার মানুষের নান্দনিক এবং বৈচিত্র্যময় পেশার সংযুক্তিতে জুতসই জনবান্ধব কাঙ্ক্ষিত আভা আনয়ন সম্ভব। এসবে প্রয়োজন সমন্বয়।

জুলাই বিপ্লবের মূল প্রেরণায়ই ছিল বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণ। যেখানটায় উঁচু-নিচু, ধনী-গরিব সবাই সমান সুযোগ এবং অধিকার ভোগ করবে। নাগরিকেরা নির্বিঘ্নে মত প্রকাশ করবে। স্বাধীনভাবে ঘুরবে। বিচারহীনতার সংস্কৃতির বিলোপ হবে। মানুষের মাঝে হানাহানি থাকবে না। লুটেরা দস্যু এবং ডাকাতের কবলে এ জনপদ আর আক্রান্ত হবে না। অথচ আশা হতাশার হিসাব নিকেশে আজ টালমাটাল। কোথায় যেন শূন্যতা? পাথরচুরির সংস্কৃতি সম্প্রসারণের জন্য কি এত রক্ত? দায় এবং জবাবদিহিতাবিহীন কর্তৃপক্ষ কি এভাবেই পার পেয়ে যাবে? এ দেশ কি দায়হীনতার সংস্কৃতি থেকে মুক্তি পাবে না? পরিবেশ উপদেষ্টা নিজেও একজন পরিবেশ আন্দোলন কর্মী। উনার বক্তব্যে যখন শুনতে হয় দস্যিপনা থেকে সাদা পাথর রক্ষার অপারগতা! আশার সম্ভাবনা কোথায় দেখব? দায় স্বীকার করে এদেশে কোনোদিন কি পদত্যাগের সংস্কৃতির চর্চা দেখতে পাবো না? যেকোনো উপায়ে আঁকড়ে ধরাই যেন আমাদের মজ্জাগত উত্তরাধিকার।

জুলাই বিপ্লব আমাদের মাঝে সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচন করেছে। সময় এখন মানসিকতা সংস্কার এবং মেরামতের। অপরাধীর কোন পরিচয় না খুঁজে লুটেরা, দস্যু এবং পরিবেশ ধ্বংসকারী হিসেবে দেখা প্রয়োজন। এখানটায় ভুল হলে আমাদের আবারোও পিছিয়ে যেতে হবে। এ জনপদকে কোনো অবস্থায়ই আমরা হত্যা করতে পারি না। পরিবেশ প্রতিবেশ এবং টেকসই উন্নয়নের স্বার্থেই একে বাঁচাতে হবে। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি সামাজিক উন্নয়ন এবং বৈশ্বিক বাস্তবতায় পর্যটন শিল্পের প্রসার সময়ের যৌক্তিক দাবি। এখানটায় জবাবদিহিতা এবং সমন্বয়ের মেলবন্ধনের বেশ প্রয়োজন। দেশপ্রেমে জাগ্রত হয়ে সবাই মিলেই সাদা পাথরকে সজীব রাখতে হবে। এ দায় সবার। নতুবা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নতুন বন্দোবস্ত প্রশ্নবিদ্ধ হবে। প্রয়োজন সামগ্রিক নীতি পরিকল্পনা এবং পারস্পরিক ঐক্য। পর্যটন শিল্পের বিকাশ ও প্রসারের পথ ধরেই বাংলাদেশে অনেক দূর এগিয়ে যাবে।

ড. মোহাম্মদ আলী ওয়াক্কাস : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

সম্পর্কিত বিষয়:

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)
আরো পড়ুন

সর্বশেষ

জনপ্রিয়

নামাজের সময়সূচি

ওয়াক্ত সময়সূচি
ফজর ০৪:১৩ ভোর
যোহর ১২:০৪ দুপুর
আছর ০৪:৩৯ বিকেল
মাগরিব ০৬.৩৭ সন্ধ্যা
এশা ০৭:৫৪ রাত

বুধবার ১৩ আগস্ট ২০২৫