সোমবার, ১৪ জুলাই ২০২৫, ২৯ আষাঢ় ১৪৩২


হঠাৎ বেকায়দায় বিএনপি!

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত:১৩ জুলাই ২০২৫, ১৯:১২

ছবি সংগৃহীত

ছবি সংগৃহীত

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর হাঁফ ছেড়ে বাঁচা বিএনপির বিপদ যেন পিছু ছাড়ছে না। শুরু থেকেই অন্যায়-অপরাধে জড়ানো নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হার্ডলাইনে থাকা দলটির নেতাদের রাজনীতির ভেতরে-বাইরে চরম বিরূপ পরিস্থিতির মুখে পড়তে হচ্ছে। সবশেষ পুরান ঢাকায় নৃশংসভাবে ভাঙারি ব্যবসায়ী সোহাগ হত্যার ঘটনায় অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের জড়িত থাকার ঘটনায় সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলো বিএনপির বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছে।

এই ঘটনায় যাদের নাম এসেছে তাদের সংগঠন থেকে আজীবন বহিষ্কারের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতের বার্তা দিয়েছে বিএনপি। এরপরও জামায়াতসহ অন্যান্য দলগুলো পুরো দায় বিএনপির ওপর চাপাচ্ছে। এমনকি হত্যার প্রতিবাদে ডাকা কর্মসূচিতে বিএনপির সর্বোচ্চ নেতাদের বিরুদ্ধেও স্লোগান তোলা হচ্ছে। বিএনপিকে চাঁদাবাজ সংগঠন হিসেবে পরিচিতি করানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।

সোহাগ হত্যাকাণ্ডের পর দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হলেও একযোগে সব রাজনৈতিক দলের এমন বিরোধিতার পেছনে ষড়যন্ত্র দেখছে বিএনপি। বিশেষ করে এমন প্রতিবাদের পেছনে বিএনপিকে বিতর্কিত করা এবং আগামী নির্বাচনকে পিছিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা মনে করছেন বিএনপি নেতারা। উদ্ভুত পরিস্থিতি সামাল দিতে দলটিকে বেশ ধকল পোহাতে হচ্ছে।

নির্বাচন নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়ার পর থেকেই নানা ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে দাবি করে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক বলেন, ‘সার্বিক পরিস্থিতি দেখলে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, নানাভাবে ষড়যন্ত্রের জাল বিছানো হচ্ছে। একেক সময় একেক ইস্যু নিয়ে ষড়যন্ত্রকারীরা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। কিন্তু বিএনপি কারও ফাঁদে পা দেবে না।’

অপরাধীদের বিষয়ে দলের অবস্থানের কথা তুলে ধরে সাবেক এই বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ বলেন, ‘আনুষ্ঠানিভাবে বলা হয়েছে অপরাধীদের জায়গা বিএনপিতে হবে না। সেই অবস্থান তো বদল হয়নি। ব্যবসায়ী সোহাগ হত্যার ঘটনায় ছাত্রদল, যুবদল সংবাদ সম্মেলন করে স্পষ্ট বিবৃতি দিয়েছে। তারেক রহমান বিষয়টি শোনার সঙ্গে সঙ্গে যাদের নাম এসেছে সবাইকে আজীবন বহিষ্কার করা হয়েছে।’

প্রশ্রয়দাতাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা চান বিশ্লেষকরা

এদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে অপরাধে জড়ানো নেতাকর্মীদের লাগাম টানতে বিএনপিকে আরও কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। বিশেষ করে অপরাধীদের প্রশ্রয়দাতাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলছেন। পাশাপাশি একদল অন্য দলকে ঘায়েল করার যে চেষ্টা চলছে তা অব্যাহত রাখলে সার্বিক পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে এমন আশঙ্কাও প্রকাশ করছেন বিশ্লেষকরা।

নৃশংস হত্যাকাণ্ডে প্রচণ্ড চাপে পড়েছে বিএনপি। ছবি: সংগৃহীত

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ডা. জাহেদ উর রহমান বলেন, ‘বিএনপিকে অভিযোগের বিষয়গুলো আরও গুরুত্ব সহকারে দেখতে হবে। শুধু যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসছে তাদের বহিষ্কার করেই কাজ শেষ করা যাবে না। এদের যারা প্রশ্রয় দেন তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে। তাহলে শৃঙ্খলা ফিরতে পারে।’

এই বিশ্লেষক বলেন, ‘বিএনপি সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার পর আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলছে। এখন সরকারে যারা আছেন তাদের তৎপর হতে হবে। কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে যিনি আছেন তিনি সহজসুলভ কথা বললেও শক্ত ব্যবস্থা নিতে পারছেন না। এটা তো স্বীকার করতে হবে। আর এক ঘটনার পর যেভাবে সবাইকে বিএনপিকে ঘায়েল করার চেষ্টা করছেন এটাও অন্যায়।’

দীর্ঘ হচ্ছে বহিষ্কারের তালিকা, তবু লাগামহীন কর্মীরা

গত বছরের আগস্টে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পতনের পর থেকে অন্তবর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়। শুরুর দিকে বিভিন্ন জায়গায় চাঁদাবাজি, দখলসহ নানা অভিযোগ আসায় নেতাকর্মীদের উদ্দেশে কড়া বার্তা দেয় বিএনপির হাইকমান্ড।

একাধিকবার বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ নেতারা অপরাধে জড়ালে ছাড় দেওয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, আওয়ামী লীগের সঙ্গে জড়িত কিংবা অন্যায়কারীদের যারা দলে নেবে তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

এরই অংশ হিসেবে এ পর্যন্ত জেলা, মহানগর, থানা এবং কেন্দ্র মিলে প্রায় সাত হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে বিএনপি শাস্তিমূলক সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিয়েছে বলে জানা গেছে। এদের মধ্যে অনেককে বহিষ্কার করা হয়েছে। কারও পদ স্থগিত হয়েছে। অনেককে শোকজ করা হয়েছে।

এছাড়াও এখন পর্যন্ত সারাদেশে নানা অপরাধে ছাত্রদলের ৩২৯ জনকে বহিষ্কার এবং ৫৪১ জন নেতাকর্মীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। আর স্বেচ্ছাসেবক দলের বহিষ্কার হয়েছেন কমপক্ষে ১০০ জন। শোকজ করা হয়েছে ১৫০ জনকে। পদ স্থগিত হয়েছে ১০০ জনের। কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে দুই শতাধিক নেতাকর্মীকে।

অন্যদিকে যুবদলেরও বহিষ্কার হয়েছেন দেড় শতাধিক নেতাকর্মী। শোকজ করা হয়েছে ৫৬ জনকে আর পদ স্থগিত হয়েছে পাঁচজনের।

দলীয় হাইকমান্ডের নির্দেশ মানছেন না নেতাকর্মীরা। ছবি: সংগৃহীত

মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) ষাণ্মাসিক মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন ২০২৫) কমপক্ষে ৫২৯টি ‘রাজনৈতিক সহিংসতার’ ঘটনায় অন্তত ৭৯ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অন্তত চার হাজার ১২৪ জন। রাজনৈতিক সহিংসতার মোট ঘটনার মধ্যে বিএনপির অন্তঃকোন্দলে ৩০২টি ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছেন ৪৬ জন এবং আহত হয়েছেন কমপক্ষে দুই হাজার ৮৩৪ জন।

এতে বলা হয়েছে, আধিপত্য বিস্তার, রাজনৈতিক প্রতিশোধপরায়ণতা, কমিটি গঠন নিয়ে বিরোধ, চাঁদাবাজি ও বিভিন্ন স্থাপনা দখলকেন্দ্রিক অধিকাংশ সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে।

যেসব কারণে বাড়ছে অপরাধ

প্রশ্ন উঠেছে- এত বহিষ্কার, কড়া বার্তার পরও কেন নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না বিএনপি নেতাকর্মীদের? দলের নেতাকর্মীরা বলছেন, দখল, টেন্ডার, চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করেই মূলত নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ হচ্ছে। এসব কাজে মাঠ পর্যায়ের পদহীন লোকজন বেশি জড়িত। অনেক জায়গায় স্থানীয় এসব কর্মীকে নেতারা প্রশ্রয় দেওয়ায় তারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছেন।

কোথাও কোথাও নিজেদের বলয় শক্তিশালী করতে স্থানীয় নেতারা আওয়ামী লীগের তুলনামূলক কম পরিচিত নেতাকর্মীদের দলে ভেড়াচ্ছেন বলেও অভিযোগ আছে। এছাড়া ত্যাগীদের বাদ দিয়ে ৫ আগস্টের পরে যারা বিএনপিতে সক্রিয় হয়েছেন তাদের সামনে আনার কারণে অপরাধে জড়ানোর প্রবণতা বাড়ছে বলে মনে করা হচ্ছে।

জয়নুল আবদিন ফারুক বলেন, ‘বিএনপি বড় দল, অনেক সুযোগ সন্ধানীরা এখন দলে ঢোকার চেষ্টা করছে। দলের পক্ষ থেকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। কেউ এদের দলে নিলে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এটা চলমান থাকবে।’

এদিকে শনিবার এক অনুষ্ঠানে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, ‘বিএনপি একটি বৃহৎ পরিবার কোনো ছিদ্রপথে দু-একজন দুষ্কৃতকারী ঢুকে পড়ে, সেটি সবসময় খোঁজ রাখা যায় না। কিন্তু দুষ্কৃতকারীদের কোনোভাবে যদি চিহ্নিত করা যায়, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কার্পণ্য করেন না দল বা দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।’

দলে শুদ্ধি অভিযান চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি। ছবি: সংগৃহীত

বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের অভিযোগ, ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য অনেক জায়গায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের পুনর্বাসন, ত্যাগীদের বাদ দিয়ে ৫ আগস্টের পর সামনে আসা কর্মীদের কোনো কোনো নেতা কাছে টানছেন। এই ঘটনা তৃণমূলে বেশি ঘটছে। তাই যারা এমন লোকদের প্রশ্রয় দিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা চান মাঠপর্যায়ের কর্মীরা।

সোহাগ হত্যার ঘটনা ভাইরাল হওয়ার পর ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি মামুন খান যুবদল ঢাকা দক্ষিণের কমিটি ভেঙে দেওয়ার দাবি জানিয়ে ফেসবুকে লাইভ করেন। এতে তিনি বলেন, ‘২৪ ঘণ্টার মধ্যে অপরাধীদের কমিটি ভেঙে না দিলে, আমরা গুলশানের চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয় অভিমুখে মার্চ করব। জানি না এই বক্তব্যের পর নিজেও খুনের শিকার হতে পারি, তবে আফসোস নাই, মরে গেছি বহু আগে। গুম ও ক্রসফায়ার থেকে আল্লাহ নিজে ফিরিয়েছেন। তবু বলবো সবার আগে বাংলাদেশ।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘অন্যায়-অপকর্মে জড়ানো নেতাকর্মীদের ব্যাপারে আমাদের কোনো অনুকম্পা নেই। সরকারকে বলব, দ্রুত অপরাধী যেই হোক তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে। দুঃখজনক বিষয় বারবার বলার পরও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোর হতে দেখছি না।’

সোহাগ হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে জামায়াতসহ রাজনৈতিক দলগুলো দেশজুড়ে যে প্রতিবাদ শুরু করেছে এর পেছনে নির্বাচন পেছানোর ষড়যন্ত্র দেখছে বিএনপি। এসব কর্মসূচি থেকে বিএনপিকে নিয়ে আপত্তিকর স্লোগান দেওয়ারও অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসবের পেছনে সরকারেরও হাত আছে এমন ধারণা বিএনপি নেতাদের।

শনিবার বিকেলে ‘জুলাই অভ্যুত্থানের দিবস’ উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, ‘ষড়যন্ত্র শেষ হয়নি। ষড়যন্ত্র কিন্তু আরও শুরু হচ্ছে, আরও জোরেশোরে শুরু হচ্ছে। বিবেকবান মানুষ বলছেন, নতুন করে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। সকলকে চোখ-কান খোলা রাখতে হবে।’

ডিএস /সীমা

সম্পর্কিত বিষয়:

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)
আরো পড়ুন

সর্বশেষ

জনপ্রিয়

নামাজের সময়সূচি

ওয়াক্ত সময়সূচি
ফজর ০৩:৫৪ ভোর
যোহর ১২:০৪ দুপুর
আছর ০৪:৪৪ বিকেল
মাগরিব ০৬.৫৩ সন্ধ্যা
এশা ০৮:১৫ রাত

সোমবার ১৪ জুলাই ২০২৫