শনিবার, ১৬ আগস্ট ২০২৫, ১ ভাদ্র ১৪৩২


বিজ্ঞানের আলোকে জন্মাষ্টমীর মাহাত্ম্য

ড. মিহির লাল সাহা

প্রকাশিত:১৬ আগষ্ট ২০২৫, ১০:৪৫

ছবি সংগৃহীত

ছবি সংগৃহীত

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সনাতন বা হিন্দু ধর্মের প্রধান দেবতা। যিনি বিষ্ণুর অষ্টম অবতার এবং স্বয়ং পরমেশ্বর ঈশ্বর হিসেবেও পরিচিত। ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহেশ্বর (শিব) হিন্দু ধর্মের তিন প্রধান দেবতা এবং এদের একত্রে ত্রিমূর্তি বা ত্রিদেব বলা হয়। ব্রহ্মা হলেন সৃষ্টির দেবতা, বিষ্ণু পালনকর্তা এবং মহেশ্বর বা শিব ধ্বংসের দেবতা। এই তিনজন দেবতা মিলে মহাবিশ্বের সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়ের চক্র পরিচালনা করেন বলে হিন্দু ধর্মাবলম্বী ভক্তরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হিন্দু ধর্মগ্রন্থ, বিশেষ করে শ্রীমদ্ভাগবদ্গীতার প্রধান চরিত্র। তিনি তাঁর করুণা, প্রেম এবং সুরক্ষার জন্য পরিচিত। তাঁকে প্রায়শই একজন যুবক ব্যক্তিত্ব, বাঁশি বাজানো, অথবা একজন জ্ঞানী শিক্ষক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। মহাভারতে ধর্ম যুদ্ধের সময় অর্জুনের রথের সারথি ছিলেন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ।

শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে যুদ্ধের ময়দানে পথ দেখিয়েছিলেন এবং তাকে তার কর্তব্য পালনে সহায়তা করেছিলেন। মহাভারতে ধর্ম যুদ্ধ বলতে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধকে বোঝায়, যেখানে পাণ্ডব ও কৌরবদের মধ্যে ধর্ম ও ন্যায়ের জন্য যুদ্ধ হয়েছিল। এই যুদ্ধে ধর্মের জয় এবং অধর্মের বিনাশের বার্তা ছিল। শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব ঘটে দুষ্টের দমন শিষ্টের পালনের জন্য।

“দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন” একটি বাংলা প্রবাদ যা অন্যায়কারীর শাস্তি এবং শান্তিপ্রিয় মানুষের সুরক্ষা ও সমর্থন করার নীতিকে বোঝায়। এর অর্থ হলো সমাজে যারা খারাপ কাজ করে তাদের দমন করা বা শাস্তি দেওয়া এবং যারা ভালো ও ন্যায়বান তাদের রক্ষা ও সমর্থন করা। এই নীতিটি প্রায়শই ন্যায়বিচার, সুশাসন এবং সমাজে শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য একটি আদর্শ হিসেবে বিবেচিত হয়।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মধ্যে দেবত্বের বিভিন্ন দিক মূর্ত রয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে প্রেম, ভালোবাসা, করুণা, সুরক্ষা এবং প্রজ্ঞা। শ্রীকৃষ্ণের জীবন মনোমুগ্ধকর গল্প এবং কিংবদন্তিতে ভরপুর। তিনি তার শৈশবের রসিকতা, গোপীদের (বিশেষ করে রাধার) সাথে তাঁর প্রেমের সম্পর্কের জন্য এবং মহাভারত মহাকাব্যে একজন জ্ঞানী ও করুণাময় পথপ্রদর্শকের ভূমিকার জন্য সুপরিচিত।

হিন্দুধর্মে বিষ্ণুর অষ্টম অবতার শ্রীকৃষ্ণ, যিনি শান্তি স্থাপনে দ্বাপর যুগে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাঁর আবির্ভাবের দিনটি জন্মাষ্টমী হিসেবে পালিত হয়। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মতে, প্রায় সাড়ে ৫ হাজার বছর আগে দ্বাপর যুগে ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে মহাবতার শ্রীকৃষ্ণ ধরাধামে আবির্ভূত হন।
পুরাণ জুড়ে শ্রীকৃষ্ণকে বিভিন্ন উপায়ে চিত্রিত করা হয়েছে, একজন খেলাধুলায় মগ্ন শিশু থেকে শুরু করে একজন ঐশ্বরিক প্রেমিক, একজন বীর যোদ্ধা এবং একজন জ্ঞানী শিক্ষক পর্যন্ত। সমগ্র ভারতবর্ষ এবং বিশ্বব্যাপী হিন্দুরা শ্রীকৃষ্ণের পূজা করেন।

শ্রীকৃষ্ণ অনেক নামে পরিচিত। প্রতিটি নামেই তাঁর ব্যক্তিত্ব এবং ঐশ্বরিক প্রকৃতির একটি ভিন্ন দিক প্রতিফলিত হয়, যেমন গোপাল, গোবিন্দ, মুরলীধর এবং কেশব। মূলত, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ একজন বহুমুখী দেবতা যার গল্প এবং শিক্ষা বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষকে অনুপ্রাণিত করে।

অত্যাচারী ও দুর্জনের বিরুদ্ধে শান্তিপ্রিয় সাধুজনের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কংসের কারাগারে জন্ম নেন তিনি। শিষ্টের পালন ও দুষ্টের দমনে শ্রীকৃষ্ণ ব্রতী ছিলেন। সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে শ্রীকৃষ্ণ তাই ভগবানের আসনে অধিষ্ঠিত। কৃষ্ণের জীবনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড (গান বা কীর্তন, গীতিনাট্য, নাট্য, যাত্রা ইত্যাদি) এর মাধ্যমে রাসলীলা, কংস বধ ইত্যাদি কর্মকাণ্ড উপস্থাপন করা হয়। মথুরা, বৃন্দাবন, মণিপুর ইত্যাদি স্থানে এই অনুষ্ঠান অত্যন্ত আড়ম্বরের সাথে করা হয়।

হিন্দু ধর্মে অনেক উৎসব রয়েছে। শ্রীকৃষ্ণের জন্মতিথি তথা জন্মাষ্টমী উৎসব অন্যতম। তিথি নক্ষত্র ছাড়াও শ্রীকৃষ্ণ কিংবদন্তিতে আট সংখ্যাটির আরেকটি তাৎপর্য রয়েছে কারণ তিনি তাঁর মা দেবকীর অষ্টম সন্তান। এই উপলক্ষটি বিশেষ করে মথুরা এবং বৃন্দাবনে সাড়ম্বরে পালন করা হয়। যেখানে শ্রীকৃষ্ণের শৈশব এবং যৌবনের অনেক মধুর এবং শিক্ষণীয় স্মৃতি রয়েছে।

উৎসব মানেই নতুন পোশাক। তাই সেদিনও নতুন পোশাক পরিধান করে পূজা করা হয়। মন্দির এবং ঘরের মন্দিরগুলো ফুল দিয়ে সাজানো হয়। জন্মাষ্টমীতে দিনভর গান, নৃত্য এবং নাটক প্রাণবন্ত এবং বর্ণিল উদযাপনের জন্য অপরিহার্য। শ্রীকৃষ্ণের প্রাথমিক জীবনের দৃশ্যগুলো চিত্রায়িত করে নাটক পরিবেশন করা হয়। মন্দিরে শ্রীকৃষ্ণের প্রতিমায় স্নান করানো হয় এবং দোলনায় স্থাপন করা হয়। একই সাথে শঙ্খ এবং ঘণ্টা বাজানো হয়। তাঁকে ভক্তি জানাতে পবিত্র মন্ত্রও জপ করা হয়।

শ্রীকৃষ্ণের জন্ম হয়েছিল মথুরায়, কংসের কারাগারে। কংসের ভয়ে শ্রীকৃষ্ণকে তৎক্ষণাৎ মথুরার বাইরে গোকুলে নন্দ ও যশোদার কাছে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। বাসুদেব শিশু শ্রীকৃষ্ণকে রাতের অন্ধকারে যমুনা নদী পার করে ওপারে নিয়ে যান। প্রবল বৃষ্টি ও বন্যার মধ্যেও যমুনা দেবী পথ করে দিয়েছিলেন বাসুদেবকে, যাতে তিনি নিরাপদে শ্রীকৃষ্ণকে গোকুলে পৌঁছে দিতে পারেন। যমুনা নদী শ্রীকৃষ্ণের লীলাভূমির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি কেবল একটি নদী নয়, এটি শ্রীকৃষ্ণের সাথে সম্পর্কিত একটি পবিত্র স্থানও বটে।

যমুনা নদীকে দেবী রূপে পূজা করা হয় এবং তিনি সূর্যদেবের কন্যা ও যমের ভগিনী। গোকুলে থাকাকালীন, শ্রীকৃষ্ণ যমুনা নদীর বিষাক্ত কালীয় সর্পকে দমন করেন। কালীয় সর্পের বিষে যমুনার জল বিষাক্ত হয়ে গিয়েছিল, যা জনজীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। শ্রীকৃষ্ণ কালীয়কে পরাজিত করে যমুনার জলকে বিষমুক্ত করেন। এই যমুনা নদীর তীরে শ্রীকৃষ্ণ গোপীদের সাথে রাসলীলা করতেন, যা ছিল তাঁর ঐশ্বরিক প্রেম ও আনন্দের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। রাসলীলার মাধ্যমে তিনি ভক্তদের সাথে মিলিত হতেন এবং আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতেন। গোকুলে তিনি নন্দ ও যশোদার আশ্রয়ে বেড়ে ওঠেন এবং "গোপাল" নামে পরিচিত হন। গোকুল ছিল তাঁর লীলাভূমি।

গোকুল ছিল একটি শান্ত, সুন্দর গ্রাম, যেখানে মানুষজন সহজ-সরল জীবনযাপন করতো। গোপালের শৈশব এই শান্ত পরিবেশে কেটেছে, যেখানে তিনি প্রকৃতির সান্নিধ্যে বেড়ে উঠেছেন এবং বিভিন্ন পশুপাখির সাথে করেছেন বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। একবিংশ শতাব্দীতে এসে আমরা এখন যে টেকসই বাস্তুতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই দ্বাপর যুগে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর ছেলেবেলায় সেটিই বোঝাতে চেয়েছেন। বাস্তুতন্ত্র টিকে থাকলে আমরা টিকে থাকব। শ্রীকৃষ্ণ দর্শন সেটিরই ইঙ্গিত বহন করে।

গোপালের শৈশবের খেলায় দেখানো হয়েছে বন্ধুত্বর গুরুত্ব। মানুষ সামাজিক জীব। তাই ছোটবেলা থেকেই শ্রীকৃষ্ণ শিশুদের সামাজিক হতে শিখিয়েছেন। বন্ধু হতে শিখিয়েছেন। যেটি বর্তমান ক্ষয়িষ্ণু সমাজে বড্ড অভাব। ফলে শিশুরা ঠিকমতো বেড়ে উঠছে না। তিনি তাঁর কর্মকাণ্ডে একজন আদর্শ বন্ধু হিসেবে শিশুদের মাঝে বিরাজমান। হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী, শ্রীকৃষ্ণের শিক্ষকের নাম ছিল সন্দীপনি। তিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত গুরু, যিনি শ্রীকৃষ্ণ এবং বলরামকে বেদ, জ্যোতিষশাস্ত্র, সংগীত, চিকিৎসা, ধনুর্বিদ্যা এবং অন্যান্য অনেক বিষয়ে শিক্ষা দিয়েছিলেন।

এখানেও শিক্ষণীয় যে, কোনো কিছু শিক্ষালাভের জন্য শিক্ষকের প্রয়োজন। আর একজন ভালো শিক্ষা লাভ করলে আলোকিত মানুষ হওয়া যায়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে শিক্ষক হিসেবে বিবেচনা করা হয়, বিশেষ করে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে। তিনি অর্জুনের সারথি এবং পথ প্রদর্শক হিসেবে গীতার মাধ্যমে জীবনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অর্জুনকে শিক্ষা দিয়েছেন। তাই, শিক্ষক হিসেবে শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকা অনন্য।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পছন্দের কিছু খাবারের মধ্যে রয়েছে ননী বা মাখন, মিছরি, রাবড়ি (দুধ, দই এবং মাখন দিয়ে তৈরি), মালপোয়া, এবং বিভিন্ন ধরনের ফল। এছাড়াও তিনি ক্ষীর, দই ও মধুও পছন্দ করতেন। শৈশবে গোপালকে ননী চুরি করে খেতে দেখা গেছে। সেই দৃশ্য অবলম্বনে 'গোপাল ননী চোরা' একটি বাংলা গানও সৃষ্টি হয়েছে। যেখানে 'ননী' চোর হিসেবে গোপালকে সম্বোধন করা হয়েছে।

এটি মূলত ভক্তিগীতি, যেখানে শ্রীকৃষ্ণকে ননী বা মাখন চুরির জন্য পরিচিত একটি ছোট ছেলে হিসেবে চিত্রায়িত করা হয়েছে। শ্রীকৃষ্ণের শৈশব থেকে যেটি শিক্ষণীয় সেটি হলো শিশুদের দই এবং মাখন খাওয়ানোর অভ্যাস করানো। হয়তো সেখান থেকেই আমাদের মায়েরা শৈশবে আমাদের নিয়মিত মাখন ও দই খাওয়াতেন। এই মাখন ও দই খাওয়ানোর অভ্যাসটি বিজ্ঞানের আলোকে যথার্থ অভ্যাস।

একবিংশ শতাব্দীতে এসে স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য দই খেতে বলা হয়। হিন্দু ধর্মের অনেক খাদ্যাভ্যাস বিজ্ঞান সম্মত। তেমনই একটি বিজ্ঞান সম্মত খাদ্য হলো দই। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় অনেক অজানাকে জানা সম্ভব হয়েছে। যেমন দই খাওয়ার প্রধানত দুটি উপকারিতা রয়েছে।

প্রথমত দই একটি দুগ্ধজাত পদার্থ। দই খাওয়া পক্ষান্তরে দুধই খাওয়া। অনেকে দুধ খেতে পারেন না। তাদের জন্য দুধের পরিবর্তে দই একটি উত্তম বিকল্প। দুধের যে পুষ্টি উপাদানের জন্য দই খেতে পারে না দইয়ে সেই পুষ্টি উপাদানটি ভেঙে খাদ্যপযোগী হয়ে যায়।

দ্বিতীয়ত দুধ থেকে দই তৈরিতে যে অণুজীব কাজ করে সেগুলো আমাদের অন্ত্রের জন্য খুবই উপকারী। এই অণুজীব হলো বিশেষ ধরনের ব্যাকটেরিয়া, যাদের এখন প্রোবায়োটিক বলা হয়। এই প্রোবায়োটিক ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতিতে অন্ত্রে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে না। ফলে আমরা দারুণভাবে উপকৃত হই।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজে দই খেয়ে আমাদের হয়তো সেটিই বোঝাতে চেয়েছেন যে, স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য তোমরা দই খাও। অন্যদিকে তাঁর ননী বা মাখনও খুব পছন্দের খাবার ছিল। সাধারণত শিশুরা চঞ্চল প্রকৃতির হয়। এই সময় শরীর দ্রুত বৃদ্ধি পায়। ছোটবেলায় শ্রীকৃষ্ণ নিজেও চঞ্চল ছিলেন। খেলাধুলা করতে প্রচুর শক্তির প্রয়োজন হয়। সেই বিবেচনায় শর্করার পাশাপাশি ননী বা মাখন শিশুদের শক্তি যোগায়। তিনি নিজে খেয়ে অন্যদের খেতে উৎসাহিত করেছেন।

জন্মাষ্টমীতে শ্রীকৃষ্ণ যা খেতে পছন্দ করতেন সেগুলো দিয়েই নৈবেদ্য সাজানো হয়। যার মধ্যে অন্যতম লুচি, দই, নিরামিষ সবজি, মাখন-মিছরি, তালের বড়া, নারকেল নাড়ু এবং মালপোয়া। এই দিনে শ্রীকৃষ্ণকে ভোগ নিবেদনের পর সেই প্রসাদ গ্রহণ করা হয়। ভাদ্র মাস মানেই তালের মাস। তাই তাল ছাড়া শ্রীকৃষ্ণ পূজা প্রায় অসম্পূর্ণ।

বাঙালিদের জন্মাষ্টমী মানেই তালের বড়া। তালের লুচিসহ নানান সুস্বাদু খাবার। জন্মাষ্টমীর দিনে এই প্রসাদগুলো শ্রীকৃষ্ণকে নিবেদন করার পর ভক্তরা তা গ্রহণ করেন এবং এটি অত্যন্ত শুভ বলে মনে করা হয়। কিছু লোক শ্রীকৃষ্ণ জন্মাষ্টমীর প্রথম দিনের জন্য সারা দিন এবং রাত উপবাস করতে পছন্দ করেন এবং মধ্যরাতে উপবাস ভাঙেন।

শারীরিক, মানসিক এবং আধ্যাত্মিক উপকারিতাসহ বিভিন্ন কারণে উপবাস গুরুত্বপূর্ণ। এটি রক্তে শর্করার নিয়ন্ত্রণ উন্নত করতে পারে, প্রদাহ কমাতে পারে এবং সম্ভাব্যভাবে জ্ঞানীয় কার্যকারিতা উন্নত করতে পারে। উপবাস আত্ম-নিয়ন্ত্রণ গড়ে তুলতে পারে, অভ্যন্তরীণ শান্তি বৃদ্ধি করতে পারে এবং ধৈর্য ও সততার মতো গুণাবলী লালন করতে পারে। এজন্য বর্তমানে বিজ্ঞানীরা উপবাসের অটোফ্যাগি বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছেন।

অটোফ্যাগি উপবাসের মধ্যে রয়েছে ক্যালোরি গ্রহণ সীমিত করা অথবা অটোফ্যাগি নামক একটি কোষীয় প্রক্রিয়াকে উদ্দীপিত করার জন্য দীর্ঘ সময় ধরে উপবাস করা। অটোফ্যাগি হলো একটি প্রাকৃতিক কোষীয় প্রক্রিয়া যার মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত বা অকার্যকর কোষীয় উপাদানগুলোর ভাঙন এবং পুনর্ব্যবহার জড়িত।

উপবাস কোষীয় চাপের একটি অবস্থা তৈরি করে অটোফ্যাগি শুরু করতে পারে। যা কোষগুলো এই স্ব-পরিষ্কার প্রক্রিয়া শুরু করতে প্ররোচিত করে। উপবাস ভাঙার পর সাধারণত নানা ধরণের মৌসুমী ফল খাওয়ার নিয়ম আছে। ফল খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। ফল সহজে হজম হয় এবং শরীরে প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করে। উপবাসের পর ফল খেলে শরীরকে পুনরায় সক্রিয় করতে দ্রুত সাহায্য করে।

ফল ভিটামিন, খনিজ এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ, যা শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করে। একই সাথে ফল সাধারণত জল সমৃদ্ধ হওয়ায় উপবাসের কারণে শরীরে জলের অভাব পূরণ করতে অত্যন্ত সহায়ক। সব মিলিয়ে উপবাসের পর ফল খাওয়া শরীরের জন্য একটি স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস। জন্মাষ্টমীর উপবাসের মাধ্যমে ভক্তরা শারীরিক ও আধ্যাত্মিক দিক থেকে পরিশুদ্ধ হতে পারে। এটি শ্রীকৃষ্ণের প্রতি ভক্তি প্রদর্শনের একটি বিশেষ উপায়। যারা এই উপবাস পালন করেন, তাদের জীবনে সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি লাভ হয় বলে বিশ্বাস করা হয়।

জন্মাষ্টমীর দিনে বাংলাদেশে, বিশেষ করে ঢাকায়, ঐতিহ্যবাহী শোভাযাত্রা বা মিছিল বের করা হয়, যা জন্মাষ্টমীর মিছিল নামে পরিচিত। ঢাকার জন্মাষ্টমীর শান্তিপূর্ণ মিছিলটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, যা পুরান ঢাকা থেকে শুরু হয়ে বিভিন্ন এলাকা প্রদক্ষিণ করে। এই মিছিলে নানা রঙের পোশাকে সজ্জিত হয়ে মানুষ অংশ নেয়।

যেখানে ভক্তরা ঢাক-ঢোল বাজিয়ে, গান গেয়ে এবং নেচে নেচে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে। রাস্তার দুই পাশে দাঁড়িয়ে সেই মিছিল উপভোগ করে করে হাজার হাজার দর্শনার্থী। একই সাথে শ্রীকৃষ্ণের প্রতি ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা নিবেদন করে। এই মিছিল ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার অংশগ্রহণে একটি মিলনমেলায় পরিণত হয়। এটি বাঙালির ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্যই সৃষ্টি হয় সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন। এটি নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি।

শ্রীকৃষ্ণের জন্ম, তাঁর শৈশব, জীবনী পাঠ, তাঁর জীবন দর্শন মানব ও বিশ্ব সমাজকে সৌভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ করার এক বাস্তব শিক্ষা দেয়। তাঁর প্রেমের বাণী অস্থির সমাজে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। শুধু দুষ্টের দমনই নয়, ঝগড়া-বিবাদ ভুলে শান্তির মিষ্টি আলোয় বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রতি বছর জন্মাষ্টমী জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সকলের মাঝে নিয়ে আসে এক শুভ আনন্দময় বার্তা।

শ্রীকৃষ্ণকে বলা হয় শান্তির প্রতীক। হিন্দুধর্ম এবং বিশেষ করে বৈষ্ণব ধর্মে শ্রীকৃষ্ণকে প্রেম, শান্তি, আনন্দ এবং ভক্তির মূর্ত প্রতীক হিসেবে পূজা করা হয়। তিনি পুরুষোত্তম নামেও পরিচিত, যাঁর অর্থ ‘শ্রেষ্ঠ পুরুষ’। শান্তির অন্বেষণে আমরা আশাবাদী। জন্মাষ্টমীতে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হোক এই প্রত্যাশা ব্যক্ত করে সবার প্রতি শ্রীকৃষ্ণ প্রেম নিবেদন করছি। শুভ জন্মাষ্টমী।

ড. মিহির লাল সাহা : অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সম্পর্কিত বিষয়:

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।)
আরো পড়ুন

সর্বশেষ

জনপ্রিয়

নামাজের সময়সূচি

ওয়াক্ত সময়সূচি
ফজর ০৪:১৪ ভোর
যোহর ১২:০৩ দুপুর
আছর ০৪:৩৮ বিকেল
মাগরিব ০৬.৩৫ সন্ধ্যা
এশা ০৭:৫১ রাত

শনিবার ১৬ আগস্ট ২০২৫